
২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ময়মনসিংহের ভালুকায় এক মর্মান্তিক ও নৃশংস ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ২৭ বছর বয়সী হিন্দু যুবক, দীপক চন্দ্র দাসকে (যিনি দিপু নামেও পরিচিত) পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং পরে তার মৃতদেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড শুধু একটি প্রাণের বিনাশ নয়, বরং এটি দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি এবং সামাজিক অসহিষ্ণুতার এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ
১৮ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার রাতে ভালুকার পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেড কারখানার শ্রমিক দীপক চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের সূত্রপাত হয় কারখানার ভেতরেই, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং কারখানার শ্রমিক ও স্থানীয় উত্তেজিত জনতা তাকে ঘেরাও করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, কারখানার ফ্লোর ইনচার্জ আলমগীর হোসেন এবং আরও কয়েকজন দীপক চন্দ্র দাসকে উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দেন, যা তার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিবর্তে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
বিক্ষুব্ধ জনতা তাকে বেধড়ক মারধর করে। মারধরের একপর্যায়ে দীপক চন্দ্র দাস মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কিন্তু নৃশংসতা সেখানেই থামেনি। হত্যাকারীরা তার মৃতদেহ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে একটি গাছে ঝুলিয়ে দেয় এবং তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই পৈশাচিক দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
পুলিশের পদক্ষেপ ও গ্রেফতার
এই ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং পুলিশ পৃথক অভিযানে এ পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন কারখানার সেই ফ্লোর ইনচার্জ আলমগীর হোসেন এবং মো. মিরাজ হোসেন আকন। র্যাব-১৪ এর অভিযানে গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলেন- মো. লিমন সরকার, মো. তারেক হোসেন, মো. মানিক মিয়া, এরশাদ আলী এবং নিজাম উদ্দিন। দীপক চন্দ্র দাসের ছোট ভাই অপু চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ভালুকা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে ব্লাসফেমির অভিযোগের কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি। অনেকেই ধারণা করছেন, কারখানার অভ্যন্তরীণ কোনো দ্বন্দ্ব বা ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে এই মিথ্যা অভিযোগ তোলা হতে পারে।
সরকার ও সমাজের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, “নতুন বাংলাদেশে এমন সহিংসতার কোনো স্থান নেই।” তিনি নিশ্চিত করেছেন যে দোষীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা বলছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এমন হামলা বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফল। ভারতের কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও এই ঘটনাকে “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ” বলে অভিহিত করেছেন এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
কেন এই অসহিষ্ণুতা?
দীপক চন্দ্র দাসের হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে শরিফ ওসমান হাদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশে যে অস্থিরতা চলছে, তার সুযোগ নিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে মানুষকে উত্তেজিত করা এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা সমাজের জন্য অশনিসংকেত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা বারবার দেখা যাচ্ছে। সঠিক তদন্ত ও বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এই চক্র ভাঙতে হলে শুধু গ্রেফতার নয়, দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ওসমান হাদী: বিপ্লবের মহানায়কের বিদায় ও রাজনৈতিক শূন্যতা
বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে
দীপক চন্দ্র দাসের নির্মম মৃত্যু আমাদের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠলেই যাচাই-বাছাই ছাড়া কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা কোনো সভ্য সমাজের কাজ হতে পারে না। এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। একই সাথে, ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং গুজব প্রতিরোধের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। একটি মানবিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।
তথ্যসূত্র:
- Youth beaten to death, body set on fire in Mymensingh – Prothom Alo
- 10 arrested over lynching involved in blasphemy allegation – The Hindu
- Dr Yunus condemns Mymensingh lynching – The Daily Star