বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর গোপন বন্দিশালার নাম ‘আয়নাঘর’। এখানে সাধারনত রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিদের আটক করা হতো। এছাড়া, শেখ হাসিনার শাসনামলে ডিজিএফআই ও র্যাব দ্বারা এসব বন্দিশালা পরিচালনা করা হতো।
আয়নাঘর কোথায় অবস্থিত?
ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর এলাকায় আয়নাঘরের অবস্থান পাওয়া গেছে, বিশেষ করে:
-আগারগাঁও (ডিজিএফআই সদর দপ্তরের পাশে)
– কচুক্ষেত (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সংলগ্ন এলাকা)
– উত্তরা (র্যাব সদর দপ্তরের কার্যালয় সংলগ্ন)
বুধবার সকালে ঢাকার আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরায় অবস্থিত তিনটি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেন তিনি।
এছাড়া, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম জানিয়েছে যে,
বাংলাদেশে ৭০০-৮০০ আয়নাঘর রয়েছে,
যেখানে বছরের পর বছর ধরে মানুষকে আটকে নির্যাতন করা হয়েছে।
আয়নাঘর পরিদর্শনে প্রধান উপদেষ্টা
গত ৬ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ডা. ইউনূস আয়নাঘর দেখবেন। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা তার সঙ্গে যাবেন।
এ প্রেক্ষিতে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (বুধবার), প্রধান উপদেষ্টা ডা. মুহাম্মদ ইউনূস বন্দিশালা পরিদর্শন করেন। তার সঙ্গে ছিলেন দেশি-বিদেশি অনেক সাংবাদিক। তিনি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেল পরিদর্শন করেছেন। এছাড়া র্যাব-২ এর সিপিসি-৩ এর ভেতরের সেলগুলোও তিনি ঘুরে দেখেন। তার সঙ্গে ছিলেন
– আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
– গৃহায়ণ উপদেষ্টা আদিলুর রহমান
– উপদেষ্টা মাহফুজ আলম
– স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব
পরিদর্শন শেষে অধ্যাপক ইউনূস বলেনঃ
“আইয়ামে জাহেলিয়া বলে একটা কথা আছে না, গত সরকার আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে। এটা তার একটি নমুনা,”
আরো জানুনঃ অপারেশন ডেভিল হান্ট সর্বশেষ আপডেট: শিকারীর শিকার শুরু
শেখ হাসিনার আয়নাঘর কিভাবে তৈরী হয়?
শেখ হাসিনার শাসনকাল ও গুমের পরিসংখ্যান জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী:
– ২০০৯-২০২১ সালের মধ্যে ৬০৫ জন গুম হয়েছেন।
– ২০১৪-২০১৯ সালের মধ্যে ৩৪৪ জন গুমের শিকার হন।
– ৪০ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৬৬ জনকে কারাগারে পাওয়া গেছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে এসব অপারেশন পরিচালিত হতো।
আয়নাঘর দেখতে কেমন?
এই বন্দিশালা একেবারে নিঃসঙ্গ, বন্ধ ঘর। সেখানে কোনো জানালা ছিল না, কোনো আলো ঢুকত না, এমনকি বাতাসও চলাচল করত না। এটি ছিল যেন একটি গভীর গুহা বা অন্ধকার কবরের মতো, যেখানে বন্দিরা দিনের আলো দেখতে পেত না। সারাক্ষণ একজস্ট ফ্যান চলত এই ঘরগুলিতে, ফ্যান বন্ধ হলেই কান্না আর গোঙানির শব্দ শুনতে পাওয়া যেত।
বিবিসি বাংলায় মাইকেল চাকমার ভাষায়,
এটি মানুষের বসবাসের উপযুক্ত কোনো জায়গা ছিল না।
তিনি আরো জানান, আয়নাঘরের একটি ছোট কক্ষে তাকে রাখা হয়েছিল। কোনো কোনো রুম ছিল মাত্র সাত ফিট বাই এগারো ফিট, আবার কিছু রুম আট ফিট বাই বারো ফিট আকারের । প্রতিটি কক্ষে ছিল একটি সরু খাট, যা হয়তো তিন ফিট বাই সাত ফিটের লোহার তৈরি ছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাঠেরও ছিল। শুরুর দিকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হননি। তবে দীর্ঘ একাকিত্ব, অন্ধকার এবং চরম নীরবতার মধ্যে থাকার ফলে এটি ছিল ভয়ংকর মানসিক নির্যাতনের মতো। তিনি বলেন, মানুষ সাধারণত এভাবে বাঁচে না—এটি ছিল অত্যন্ত অমানবিক এক পরিস্থিতি।
গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন,
ইতোমধ্যেই অনেক আলামত নষ্ট করা হয়েছে
আয়নাঘরে কি করা হতো বন্দিদের সাথে?
জুলাই অভ্যুথ্বানের সময় উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নিজেদের বন্দি থাকার কক্ষগুলো চিহ্নিত করেন। তারা জানিয়েছেন যে, সেখানে ২৪ ঘণ্টা ক্যামেরার নজরদারি ও অমানবিক নির্যাতন চলতো।
এখানে বন্দিদেরঃ
– ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো
– মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হতো
– পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে দেওয়া হতো না।
ভারতীয় সাংবাদিক অর্ক দেব এর মতে ‘হাই ভ্যালু’ বন্দিদের ইলেকট্রিক শক দিতে ব্যবহার হতো এই চেয়ার। আরো জানুনঃ ডিজিএফআই এর কারনে পতনঃ আসাদুজ্জামান খান কামাল সাক্ষাৎকার
Aynaghar এর দায় কার?
গোপন কক্ষগুলোতে সাধারণত গুম করে আনা ব্যক্তিদের আনা হতো। গুমের ঘটনায় জড়িত কয়েকজন ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন
– শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক
– মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, এনটিএমসি, সাবেক মহাপরিচালক
– মো. মনিরুল ইসলাম, পুলিশ কর্মকর্তা
– মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ডিবি
ইতোমধ্যে অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে অন্য অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
কমিশনের সদস্যরা গুমের ঘটনায় বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করার পাশাপাশি র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছেন। আগামী মার্চ মাসে গুমের বিষয়ে আরও বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।
মায়ের ডাক- সংগঠনের ক্ষোভ প্রকাশ
গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এই পরিদর্শনে ডাক না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বলেন:
“আমরা দীর্ঘ ১২-১৩ বছর ধরে আন্দোলন করছি, অথচ আমাদের কোনো প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি।”
ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য মাইকেল চাকমা, যিনি ৫ বছরের বেশি সময় আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন, জানিয়েছেন: >
“আমাকে যদি ডাক দেওয়া হতো, আমি দেখিয়ে দিতে পারতাম কোথায় কী হয়েছিল।”
ইতোমধ্যে জাতিসংঘ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
Aynaghar এক ভয়ংকর বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এই গোপন বন্দিশালাগুলোতে নিরীহ মানুষদের আটকে রেখে ভয়ংকর নির্যাতন করা হয়েছে। এখন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব গোপন বন্দিশালা উন্মোচন করে বিচার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে, বাস্তবে কতটা সফল হবে, সেটাই দেখার বিষয়।
প্রশ্নোত্তর (FAQs)
- আয়নাঘর কি?
– আয়নাঘর হলো বাংলাদেশে গোপন বন্দিশালা, যেখানে বিরোধীদের আটকে রাখা হতো।
- আয়নাঘর কোথায় অবস্থিত?
– ঢাকার আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরাসহ সারাদেশে প্রায় ৭০০-৮০০টি আয়নাঘর আছে বলে জানান প্রেস সচিব।
- কে আয়নাঘর পরিদর্শন করেছেন?
– অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা এবং সাংবাদিক।
- গুম হওয়া ব্যক্তিরা কোথায় ছিলেন?
– আয়নাঘরের টর্চার সেলগুলোতে আটক ছিলেন।
- এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কেমন?
– জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামক বিশেষ অভিযান শুরু হয় সারা দেশে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে এ অপারেশন যৌথভাবে পরিচালনা দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ।