তোমরা সত্যকে মিথ্যের সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না। @@ surah baqara ayat 42 Al Quran 2:42 @@

ওসমান হাদী: বিপ্লবের মহানায়কের বিদায় ও রাজনৈতিক শূন্যতা

ওসমান হাদী: বিপ্লবের মহানায়কের বিদায় ও বাংলাদেশে তার রেখে যাওয়া রাজনৈতিক শূন্যতা

ওসমান হাদী: বিপ্লবের মহানায়কের বিদায় ও রাজনৈতিক শূন্যতা
ওসমান হাদী: বিপ্লবের মহানায়কের বিদায় ও রাজনৈতিক শূন্যতা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত এবং শোকাবহ ঘটনা হলো তরুণ ছাত্রনেতা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদীর অকাল প্রয়াণ। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে তার এই আকস্মিক মৃত্যু পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম এই নায়কের বিদায় শুধুমাত্র একটি প্রাণের অবসান নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ওসমান হাদীর জীবনী, তার রাজনৈতিক দর্শন, এবং তার মৃত্যু পরবর্তী পরিস্থিতির বিস্তারিত আলোচনা করব।

কে ছিলেন এই ওসমান হাদী?

শরীফ ওসমান হাদী ছিলেন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এক পরিচিত মুখ। তিনি ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ নামক একটি বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং মুখপাত্র ছিলেন। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে যে ছাত্র-জনতার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার সামনের সারির নেতাদের মধ্যে ওসমান হাদী ছিলেন অন্যতম। তার জ্বালাময়ী ভাষণ এবং সাহসী নেতৃত্ব তাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে এক আইকনে পরিণত করেছিল।

তিনি বিশ্বাস করতেন একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নে, যেখানে কোনো বিদেশি শক্তির আধিপত্য থাকবে না। বিশেষ করে, তিনি বাংলাদেশে ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদ’-এর বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তার এই স্পষ্টবাদী রাজনৈতিক অবস্থান তাকে যেমন জনপ্রিয় করেছিল, তেমনি অনেকের চক্ষুশূলেও পরিণত করেছিল।

মর্মান্তিক হত্যাকান্ড এবং মৃত্যু

২০২৫ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার পুরানা পল্টনে এক নির্বাচনী প্রচারণার সময় মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন ওসমান হাদী। তিনি আসন্ন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গুলিবদ্ধ হওয়ার পর তাকে প্রথমে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তার অবস্থার অবনতি হলে ১৫ ডিসেম্বর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়।

সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই তরুণ নেতা। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে পুরো দেশ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই ঘটনাকে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং ২০ ডিসেম্বর জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেন।

দেশব্যাপী বিক্ষোভ এবং প্রতিক্রিয়া

ওসমান হাদীর মৃত্যুর খবর পৌঁছানোর সাথে সাথেই ঢাকা সহ সারা দেশে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়। তার সমর্থক এবং সাধারণ ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং শাহবাগ মোড় জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা বিচার এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায়।

দুর্ভাগ্যবশত, এই বিক্ষোভের সময় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের মতো কিছু সংবাদপত্রের অফিসে হামলার খবর পাওয়া যায়। आंदोलनকারীরা অভিযোগ করেন যে, এই মিডিয়াগুলো বিপ্লবের সঠিক চিত্র তুলে ধরেনি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। তবে ওসমান হাদীর পরিবার এবং ইনকিলাব মঞ্চের নেতারা সবাইকে শান্ত থাকার এবং অহিংস উপায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। আরো খবর

জাতীয় কবির পাশে চিরনিদ্রা

পরিবারের ইচ্ছা এবং জাতীয় বীর হিসেবে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, শরীফ ওসমান হাদীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে দাফন করা হয়। এটি একটি বিরল সম্মান, যা প্রমাণ করে যে তিনি জাতির কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তার জানাজায় লক্ষ লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করে, যা সাম্প্রতিক অতীতে কোনো রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

ওসমান হাদীর রাজনৈতিক দর্শন এবং প্রভাব

ওসমান হাদী কেবল একজন নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি আদর্শের প্রতীক। তিনি মনে করতেন, ২০২৪ এর বিপ্লব কেবল সরকার পরিবর্তনের জন্য নয়, বরং এটি একটি রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের আন্দোলন।

মূল রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলো:

  • সার্বভৌমত্ব রক্ষা: তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি স্বাধীন হওয়া উচিত এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর অন্যায্য হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া উচিত নয়।
  • শহীদদের অধিকার আদায়: জুলাই বিপ্লবের শহীদদের রক্তের মর্যাদা রক্ষা এবং আহতদের পুনর্বাসন তার প্রধান এজেন্ডা ছিল।
  • বিপ্লবী সাংস্কৃতিক জাগরণ: ইনকিলাব মঞ্চের মাধ্যমে তিনি একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, যা তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলবে।

আগামীর বাংলাদেশ এবং ওসমান হাদীর প্রাসঙ্গিকতা

ওসমান হাদীর মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় শূন্যতা তৈরি করেছে। তবে তার আদর্শ এবং স্বপ্ন মৃত্যুহীন। তার অনুসারীরা মনে করেন, ওসমান হাদী তাদের চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে তার অনুপস্থিতি ঢাকা-৮ আসনের ভোটারদের জন্য এক বিশাল ক্ষতি।

বিশ্লেষকদের মতে, ওসমান হাদীর হত্যা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল হতে পারে। তার জনপ্রিয়তা এবং আপোষহীন মনোভাবই হয়তো তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে হত্যাকারীরা তাকে হত্যা করতে পারলেও, তার জাগিয়ে তোলা চেতনাকে হত্যা করতে পারেনি।

উপসংহার

শরীফ ওসমান হাদী আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া সাহস এবং দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত চিরকাল অম্লান থাকবে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন এবং তার পরিবারকে এই শোক সইবার শক্তি দিন।

Osman Hadi Wikipedia

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!