এক রাতে তীব্র জ্বর, মাথা ব্যথা, আর খাওয়ার অনীহা—এটাই হতে পারে ডেঙ্গুর শুরু। আপনি কী জানেন, এই ছোট ভুলেই অনেক প্রাণ ঝরে যাচ্ছে? শুধু সময়মতো চিকিৎসা আর কিছু খাবার বদলেই ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ২০২৫ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুর প্রকোপ এখন শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের এই গাইডে আমরা জানাবো এর লক্ষণ, ডেঙ্গু হলে কি করবেন, কি খাবেন এবং কখন হাসপাতালে যাবেন—সব বাংলায়, সহজভাবে।
ডেঙ্গুর লক্ষণ ও উপসর্গ
ডেঙ্গু রোগ শুরু হয় সাধারণত তীব্র জ্বর দিয়ে। জ্বরের মাত্রা ১০২ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। সঙ্গে থাকে মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে চাপের মতো ব্যথা এবং এক ধরনের “হাড় ভাঙা” ব্যথা— বিশেষ করে জয়েন্ট ও পেশীতে। রোগের শুরু থেকে ২-৩ দিনের মধ্যেই অনেকের ক্ষেত্রে বমি শুরু হয়, খাবারে অরুচি দেখা দেয়। দুর্বলতা এতটাই হয় যে রোগী স্বাভাবিক হাঁটাচলাও করতে পারে না। গুরুতর অবস্থায় দেখা দিতে পারে:
- ত্বকে লাল র্যাশ
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
- হঠাৎ রক্তক্ষরণ (মুখ, নাক বা মলদ্বার থেকে)
- মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এগুলো ক্রিটিক্যাল ফেজ এর লক্ষণ এবং তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা জরুরি।
প্রাথমিক পরীক্ষায় ডেঙ্গু হলে কি করবেন
ডেঙ্গু সন্দেহ হলে বা উপসর্গ দেখা দিলে প্রথমেই আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।
- প্যারাসিটামল সেবন করুন
- জ্বর কমাতে ৬ ঘণ্টা পরপর ৫০০–৬৫০mg প্যারাসিটামল গ্রহণ করা যায়।
- অ্যাসপিরিন ও আইবুপ্রোফেন খাওয়া যাবে না: এই ওষুধগুলো রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়।
- জ্বর নিয়ন্ত্রণে শরীর মুছিয়ে দিন: ঠান্ডা পানিতে কাপড় ভিজিয়ে মাথা ও শরীর মুছানো জরুরি।
- বিশ্রাম নিন: যতটা সম্ভব শুয়ে বিশ্রাম নিন, কাজকর্ম একেবারে বাদ দিন।
- রক্ত পরীক্ষা করুন: প্রতিদিন অন্তত ১ বার CBC (Complete Blood Count) করান, বিশেষ করে প্লেটিলেট ও হেমাটোক্রিট এর মান দেখে চিকিৎসক বুঝতে পারবেন রোগের অবস্থা।
- শুরুতেই টেস্ট করুন: জ্বরের প্রথম ৫ দিনের মধ্যে NS1 Antigen Test করালে ডেঙ্গু নির্ণয় সহজ হয়।
- ৬ দিন পর IgM/IgG টেস্ট করাতে হবে। প্রতিদিন ২টি করে ডিম খাওয়ার উপকারিতা এত বেশি?
ডেঙ্গু হলে কি খাবেন?
যা খাবেন:
- প্রচুর পানি, ওরস্যালাইন, রাইস স্যালাইন
- ডাবের পানি ও কমলার রস: শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ও ভিটামিন সি পূরণ করে
- পেঁপে পাতা জুস: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে এটি প্লেটিলেট বাড়াতে সহায়ক হতে পারে
- সহজে হজমযোগ্য খাবার: খিচুড়ি, ভাত, মাছ, ডাল, স্যুপ
- পুষ্টিকর ফল: ডালিম, কিউই, ব্রোকলি, পালংশাক, হলুদ মেশানো দুধ
ডেঙ্গু হলে কি খাবেন না:
- তেলে ভাজা খাবার (স্ন্যাকস, ফাস্ট ফুড)
- অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার (পাকস্থলী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে)
- কফি বা এনার্জি ড্রিংক (ক্যাফেইন হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়)
কখন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার?
প্রাথমিক ডেঙ্গু বাসায় থেকে ভালো হয়ে গেলেও, কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিলেই দেরি না করে হাসপাতালে যেতে হবে:
- টানা বমি বা পাতলা পায়খানা
- তীব্র পেট ব্যথা ও পেট ফোলা
- প্রেসার কমে যাওয়া বা দুর্বলতা বেড়ে যাওয়া
- রক্ত বমি, প্রস্রাবে সমস্যা, অথবা চামড়ায় লাল দাগ
- প্লেটিলেট দ্রুত কমে যাওয়া (৪০,০০০ এর নিচে নামা)
- শ্বাসকষ্ট শুরু হলে বা মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হলে
এই লক্ষণগুলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বা হেমোরেজিক ফিভার এর ইঙ্গিত দিতে পারে, যা সময়মতো চিকিৎসা না পেলে মারাত্মক হতে পারে। খেজুরের রসের মাধ্যমে রিওভাইরাস (Reo Virus) ছড়াচ্ছে? ০৫ জন শনাক্ত:
ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর করণীয়
ডেঙ্গু থেকে জ্বর সেরে গেলেও রোগী পুরোপুরি সুস্থ হন না। বেশিরভাগ রোগী কয়েক সপ্তাহ ধরে দুর্বলতা, মাথাঘোরা, খাবারে অনীহা এবং মনোযোগের অভাবে ভোগেন। এজন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় অনুসরণ করতে হবে:
- প্রচুর বিশ্রাম: অন্তত ৮–১০ ঘণ্টা ঘুম এবং দিনে কয়েকবার বিশ্রাম রোগীর দ্রুত পুনরুদ্ধারে সহায়ক।
- পানি ও তরল পান করুন: শরীর থেকে ডিহাইড্রেশন কাটাতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি, ওরস্যালাইন, ডাবের পানি খেতে হবে।
- সুষম খাবার খেতে হবে: ভাত, মাছ, ডাল, শাক-সবজি, ফলমূলের পাশাপাশি উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার (ডিম, মুরগি) সেবন করুন।
- প্লেটিলেট রিপোর্ট ফলোআপ: জ্বর কমার ৩–৫ দিন পর আবার CBC রিপোর্ট করে প্লেটিলেট ও হেমাটোক্রিট চেক করুন।
- পর্যায়ক্রমে কাজ শুরু: দুর্বলতা কেটে গেলে হঠাৎ করেই পূর্ণ কাজ না করে ধীরে ধীরে রুটিনে ফিরুন।
- মশার প্রতিরোধ চালিয়ে যান: সেরে ওঠার পর কমপক্ষে এক মাস পর্যন্ত মশারি ব্যবহার করুন, কারণ আবার সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যায়।
কীভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করবেন?
ডেঙ্গুর মূল কারণ এডিস মশা, যা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে সবার আগে:
- জমে থাকা পানি পরিষ্কার করুন: ফুলদানি, গামলা, এসির ট্রে, ড্রাম, ব্যবহৃত টায়ার—এসব জায়গায় জমা পানি ৩ দিনের বেশি রাখা যাবে না।
- সকাল ও বিকেলে স্প্রে করুন: ঘরের ভেতরে ও বাইরে নিয়মিত মশা মারার স্প্রে ব্যবহার করুন।
- ফুলহাতা জামা ও মোজা পরুন: এডিস মশা সাধারণত পা ও হাত কামড়ায়, তাই শরীর ঢেকে রাখুন।
- ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করুন: মশা নিধনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো মশারি। ঘুমের সময় এটি বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করুন।
- বাড়ির চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখুন: আবর্জনা, গাছের পাতা, ডাস্টবিনে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
২য় বার ডেঙ্গু হলে কি করতে হবে?
অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে, আগে ডেঙ্গু হয়েছিল, আবার কি হবে? উত্তর—হ্যাঁ, এবং দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে ঝুঁকি দ্বিগুণ।
২য় বার আক্রান্ত হলে হতে পারে:
- Dengue Hemorrhagic Fever (DHF)
- Dengue Shock Syndrome (DSS)
এই অবস্থায় রক্তক্ষরণ, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়া, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই গায়ের মতো ওষুধ খাওয়া যাবে না।
ডেঙ্গু বিষয়ক ভুল ধারণা ভাঙুন :
পেঁপে পাতায় ডেঙ্গু ১০০% ভালো হয়”
পেঁপে পাতা প্লেটিলেট বাড়াতে সহায়ক হতে পারে, তবে চিকিৎসা নয়। এটি শুধু সহায়ক খাবার হিসেবে কাজ করে।
ডেঙ্গু হলে কী কী খাবেন?
ডেঙ্গু হলে পানি, ওরস্যালাইন, ডাবের পানি, রাইস স্যালাইন, কমলার রস, ডালিম, পেঁপে পাতার জুস, ভাত, খিচুড়ি, মাছ, ডাল ইত্যাদি সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত।
ডেঙ্গু রোগী কি ওটস খেতে পারবেন?
হ্যাঁ, ওটস (Oats) হালকা ও সহজপাচ্য হওয়ায় ডেঙ্গু রোগীর জন্য উপযোগী। তবে এটি দুধ বা ফলের সাথে খেলে বেশি উপকারি হয়।
ডেঙ্গুর লক্ষণ কী কী?
(২০২৪ আপডেট) উচ্চ জ্বর (১০২–১০৫°), মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, শরীর ব্যথা, বমি, অরুচি, দুর্বলতা, চামড়ায় র্যাশ, রক্তক্ষরণ বা প্রস্রাব কমে যাওয়া—এসবই ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণ।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও চিকিৎসা কী?
লক্ষণ: জ্বর, বমি, ব্যথা, র্যাশ চিকিৎসা: প্যারাসিটামল, বিশ্রাম, পানি ও রক্ত পরীক্ষা করে প্লেটিলেট মনিটর করা। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ নয়।
ডেঙ্গু জ্বর কতদিন থাকে?
সাধারণভাবে ডেঙ্গু জ্বর ৫–৭ দিন থাকে। তবে দুর্বলতা ও অন্যান্য উপসর্গ ১০–১৫ দিন পর্যন্ত চলতে পারে।
জ্বরে কাঁঠাল খেলে উপকার হয় কি?
কাঁঠালে প্রাকৃতিক শর্করা ও ভিটামিন থাকলেও এটি ভারী ও গরম জাতীয় খাবার। তাই ডেঙ্গু বা সাধারণ জ্বরে কাঁঠাল খাওয়া এড়িয়ে চলাই ভালো।
ডেঙ্গু রোগে প্লেটিলেট কত থাকা দরকার?
স্বাভাবিক প্লেটিলেট ১.৫ থেকে ৪.৫ লাখ। ডেঙ্গু হলে এটি ১ লাখের নিচে নামলে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। ২০,০০০ এর নিচে এলে হাসপাতাল ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে কি পাতলা পায়খানা হয়?
হ্যাঁ, অনেক রোগীর ক্ষেত্রে পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া দেখা দেয়। এটি ডেঙ্গুর জটিলতা নির্দেশ করতে পারে।
ডেঙ্গু হলে কী খাবার খাওয়া যাবে না?
ভাজাপোড়া, মসলাযুক্ত, অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার ও ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (কফি, এনার্জি ড্রিংক) এড়িয়ে চলতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে কি স্যালাইন খাওয়া যাবে?
অবশ্যই। ওরস্যালাইন বা রাইস স্যালাইন খেলে পানিশূন্যতা কাটে এবং শরীর শক্তি পায়। তবে অতিরিক্ত না খেয়ে বারবার অল্প অল্প করে খেতে হবে।
উপসংহার ডেঙ্গু জ্বর এখন আর সাধারণ জ্বর নয়— এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য কিন্তু অবহেলায় প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। সময়মতো রক্ত পরীক্ষা, বিশ্রাম, উপযুক্ত খাবার এবং সঠিক চিকিৎসা নিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুস্থ হওয়া সম্ভব। সচেতনতার মাধ্যমে আপনি নিজেকে, আপনার পরিবারকে এবং আশেপাশের মানুষদের রক্ষা করতে পারেন। এখনই পরিচ্ছন্নতা শুরু করুন, নিয়মিত মশারি ব্যবহার করুন এবং জ্বর আসলেই সতর্ক থাকুন। **সতর্ক থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন।