তোমরা সত্যকে মিথ্যের সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না। @@ surah baqara ayat 42 Al Quran 2:42 @@

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা: সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় এক গভীর সংকট

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা:

 

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসটি একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি সংবাদমাধ্যম—প্রথম আলোদ্য ডেইলি স্টার-এর কার্যালয়ে নজিরবিহীন হামলার ঘটনা শুধু সাংবাদিক সমাজকেই নয়, বরং পুরো দেশবাসীকে স্তম্ভিত করেছে। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদীর মৃত্যুর পর সৃষ্ট উত্তেজনার জেরে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই দুই পত্রিকার অফিসে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা দেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর এক বড় আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

হামলার প্রেক্ষাপট ও ঘটনার সূত্রপাত

এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সূত্রপাত হয় ১২ ডিসেম্বর ২০২৫-এ, যখন ইনকিলাব মঞ্চের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদী ঢাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হন। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। হাদীর এই মৃত্যু তার অনুসারী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়।

হাদীর মৃত্যুর পরপরই ‘তৌহিদী জনতা’ ও বিভিন্ন ইসলামপন্থী সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, প্রথম আলোদ্য ডেইলি স্টার দীর্ঘদিন ধরে ভারত-ঘেঁষা নীতি অবলম্বন করছে এবং দেশবিরোধী সংবাদ প্রচার করছে। বিশেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) সহ-সভাপতি মোস্তাকুর রহমান প্রকাশ্যে এই দুই পত্রিকা বন্ধের আহ্বান জানানোর পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব বক্তব্যের ব্যাপক প্রচারের ফলে বিক্ষুব্ধ জনতা দেশের বিভিন্ন জেলায় পত্রিকা দুটির কার্যালয় লক্ষ্য করে হামলা চালায়।

নজিরবিহীন সহিংসতা ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

১৮ ডিসেম্বর রাত এবং ১৯ ডিসেম্বর দিনভর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার অফিসে হামলা চালানো হয়। রাজধানী ঢাকার কারওয়ার বাজারে প্রধান কার্যালয় থেকে শুরু করে রাজশাহী, কুষ্টিয়া, খুলনা ও সিলেট ব্যুরো অফিসগুলোও এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি।

রাজশাহীতে বিক্ষুব্ধ জনতা দুই পত্রিকার অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় এবং আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় সাংবাদিকরা অফিসের ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সিলেটের জিন্দাবাজারেও একই চিত্র দেখা যায়, যেখানে অফিসের সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলা হয় এবং নথিপত্রে আগুন দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, হামলাকারীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে অফিসে প্রবেশ করে এবং কোনো বাধা ছাড়াই তাণ্ডব চালায়। এই হামলায় শুধু ভৌত অবকাঠামোর ক্ষতি হয়নি, বরং সংবাদকর্মীদের মনে দীর্ঘস্থায়ী ভীতির সঞ্চার হয়েছে, যা একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের কাজের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

রাজশাহীতে প্রথম আলো অফিসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ

সরকার ও সাংবাদিক সমাজের তীব্র প্রতিক্রিয়া

এই ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনায় তাৎক্ষণিক এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এই হামলাকে “বর্বরোচিত”, “অনাকাঙ্ক্ষিত” এবং “স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর আঘাত” হিসেবে অভিহিত করেছেন। ড. ইউনূস প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন এবং তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, দ্বিমত প্রকাশের অধিকার সবারই আছে, কিন্তু সংবাদমাধ্যমে হামলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না।

অন্যদিকে, সম্পাদক পরিষদ (Editors’ Council) এবং নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (NOAB) এক যৌথ বিবৃতিতে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেন, “সংবাদপত্রের অফিসে হামলা মানে গণতন্ত্রের ওপর হামলা।” সাংবাদিক নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে কীভাবে এমন সংগঠিত হামলা হতে পারে? তারা অবিলম্বে হামলাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সও এই ঘটনাকে জনগণের তথ্য জানার অধিকারের ওপর আঘাত বলে উল্লেখ করেছে।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হামলার প্রতিবাদে সাংবাদিকদের বিক্ষোভ

আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ ও নিরাপত্তা শঙ্কা

এই হামলার রেশ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও ছড়িয়ে পড়েছে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (CPJ) এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, সংবাদমাধ্যমের ওপর এমন রাজনৈতিক ও গোঁড়া গোষ্ঠীর আক্রমণ বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এক অশনিসংকেত।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, বিশেষ করে যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরও কিছু বিচ্ছিন্ন হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমকে ‘দেশবিরোধী’ বা ‘ভারতের দালাল’ তকমা দিয়ে আক্রমণ করার এই প্রবণতা প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

হামলার পর সংবাদপত্রের অফিসের সামনে নিরাপত্তা জোরদার

সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ ও করণীয়

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার অফিসে হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি একটি অসহিষ্ণু সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। ভিন্নমত দমনের এই সহিংস পথ পরিহার করতে না পারলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হবে। সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ; একে দুর্বল করা মানে রাষ্ট্রকেই দুর্বল করা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করা এবং দোষীদের আইনের আওতায় আনা। একই সাথে, রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে তাদের কর্মীদের সংযত আচরণের আহ্বান জানাতে হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা শুধুমাত্র সাংবাদিকদের দায়িত্ব নয়, এটি সমগ্র জাতির দায়। দ্বিমত থাকলে তা লেখনী বা আইনি পথে মোকাবিলা করা উচিত, সহিংসতার মাধ্যমে নয়।

পরিশেষে বলা যায়, শরিফ ওসমান হাদীর মৃত্যুর বিচার যেমন কাম্য, তেমনি সেই আবেগকে পুঁজি করে সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। একটি সহনশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে হলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।


তথ্যসূত্র:

  1. Prothom Alo Office Attacked – The Daily Star
  2. Chief Adviser Condemns Attack – Tribune Report
  3. Editors Council Statement – Samakal

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!