প্লেনে খাবার নেওয়ার প্রবণতা অনেক যাত্রীর মধ্যে দেখা যায়। বিশেষ করে যেসব যাত্রী দীর্ঘ রুটে ভ্রমণ করেন কিংবা কোন বিশেষ ডায়েট অনুসরণ করেন। অনেক মা-বাবা শিশুখাদ্য বহন করেন। অনেকে আবার নিরাপত্তাজনিত কারণে অথবা ধর্মীয় ও স্বাস্থ্যগত কারণেও নিজস্ব খাবার নিতে চান। কিন্তু আন্তর্জাতিক কাস্টমস আইন অনুযায়ী এবং প্রতিটি দেশের বিমানবন্দর নিরাপত্তা পদ্ধতি ভিন্ন হওয়ায় সব ধরনের খাবার বিমানে বহন করতে দেয়া হয় না।
কিছু খাবার আছে যেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, সংক্রামক জীবাণু বহনের আশঙ্কা থাকে অথবা অন্য যাত্রীর জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে। তাই আগেই জেনে না নিলে যাত্রার দিনে বিমানে ওঠার আগে কাস্টমস বা নিরাপত্তা চেকিংয়ে বাধা পেতে পারেন। এমনকি জরিমানার মুখেও পড়তে হতে পারে।
২০২৫ সালে প্লেনে খাবার নেয়ার নিয়ম কি?
২০২৫ সালে বেশ কিছু দেশে বিমানে খাবার বহনের নিয়মে পরিবর্তন এসেছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো দেশগুলো বায়োসিকিউরিটি আইনের আওতায় কাঁচা ফল ও সবজি নিষিদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে দুগ্ধজাত পণ্যের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী তরলজাতীয় খাবার ১০০ মিলিলিটারের বেশি হলে হ্যান্ড লাগেজে বহন করা যাবে না source: [https://www.tsa.gov/travel/security-screening/whatcanibring/food)
বিমানে খাবার নেওয়ার সাধারণ নিয়ম
হ্যান্ড লাগেজ ও চেক-ইন লাগেজে পার্থক্য
বিমানে দুটি ধরণের লাগেজ বহন করা হয়—হ্যান্ড লাগেজ (Carry On Luggage)ও চেক-ইন (Check-In)লাগেজ। সাধারণত হ্যান্ড লাগেজে কড়া নিরাপত্তা পরীক্ষা হয়, তাই এখানে তরলজাতীয়, গন্ধযুক্ত বা সন্দেহজনক খাবার নেওয়াতে বিধিনিষেধ বেশি। চেক-ইন লাগেজে কিছুটা শিথিলতা থাকলেও, সব খাবার বহনযোগ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, তরল খাবার বা দুধজাত পণ্য চেক-ইনে নেওয়া গেলেও অনেক দেশে তা প্রবেশের সময় আটকায়।
আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ভিন্নতা
অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে সাধারণত খাবারের বিষয়ে কিছুটা সহজ নিয়ম অনুসরণ করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে কাস্টমস ও নিরাপত্তা জটিলতার কারণে নিয়ম অত্যন্ত কঠোর। কাঁচা ফল, দুধ, মাংস জাতীয় পণ্য কিংবা বাসায় তৈরি প্যাকেজ খাবার—এসবের ওপর বিশেষ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
কোন খাবার প্লেনে নেওয়া যাবে না?
- তরলজাত খাবার (১০০ মি.লি. এর বেশি) যেমন: পানির বোতল, জুস, দুধ, স্যুপ — হ্যান্ড লাগেজে নিষিদ্ধ। এগুলো নিতে হলে স্বচ্ছ প্যাকেট ও নিরাপত্তা চেকিং প্রয়োজন।
- ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত খাবার যেমন: শুঁটকি, পেঁয়াজ, ভুনা মাংস — যদিও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু অন্যান্য যাত্রীর অসুবিধার কারণে অনেক এয়ারলাইন অনুমতি দেয় না।
- কাঁচা ফল ও সবজি যেমন: আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে — অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ, কারণ এতে জীবাণু বা কীটপতঙ্গ ছড়াতে পারে।
- প্রক্রিয়াজাত নয় এমন দুগ্ধজাত পণ্য যেমন: দুধ, দই, ছানা — অনেক দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা।
- নিজের রান্না করা খাবার যদি ঠিকমতো প্যাক করা না হয়, উৎস না থাকে — কাস্টমস তা সন্দেহজনক হিসেবে আটকে দিতে পারে।
✈️ নিরাপদ ভ্রমণের জন্য এসব নিয়ম জানা জরুরি—নইলে শেষ মুহূর্তে খাবার ফেলে দিতে হতে পারে বা জরিমানা হতে পারে।
কোন খাবার প্লেনে নেওয়া নিরাপদ এবং অনুমোদিত?
- শুকনো খাবার – বিস্কুট, চিপস, কেক শুকনা ও গন্ধহীন খাবার সাধারণত নিরাপদ ও অনুমোদিত। এসব হ্যান্ড লাগেজে রাখা যায় এবং নিরাপত্তার ঝামেলা নেই।
- প্রস্তুত করা প্যাকেট খাবার বাজারজাত করা ব্র্যান্ডেড খাবার, যেগুলোর উপকরণ ও প্রস্তুত প্রক্রিয়া প্যাকেটে উল্লেখ থাকে—এগুলো নিরাপদ ও অনুমোদিত। যেমন: ইনস্ট্যান্ট নুডলস, রেডি-টু-ইট ফুড প্যাক, হালকা খাবার ইত্যাদি।
- ছোট প্যাকেটের চকলেট বা স্ন্যাকস ছোট প্যাকেটের স্ন্যাকস বা চকলেট সহজেই বহনযোগ্য এবং কোনো ঝামেলা ছাড়াই প্লেনে নেওয়া যায়। এগুলো শিশু ও বড়দের জন্যও সুবিধাজনক।
- শিশুর জন্য স্পেশাল খাবার অনুমোদন শিশুর দুধ, বেবি ফুড বা ওষুধ সাধারণত অনুমোদিত থাকে, তবে আলাদা করে তা ফর্মে ঘোষণা করতে হয়। TSA ও IATA অনুযায়ী শিশুর খাদ্য বা ওষুধের ক্ষেত্রে সীমা কিছুটা শিথিল (source: https://www.iata.org/en/youandiata/travelers/health
বাণিজ্যিক পরিমাণে খাবার নিলে কী হয়?
- অতিরিক্ত পরিমাণ খাবার (যেমন: ৫-১০ কেজি শুঁটকি, মিষ্টি, ছানা) অনেক দেশে কমার্শিয়াল পরিমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
- কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স লাগে — খাবারের উৎস, পরিমাণ ও ব্যবহারের উদ্দেশ্য জানাতে হতে পারে।
- শুল্ক ফি দিতে হতে পারে, বিশেষ করে ইউরোপ, সৌদি আরব ও কানাডার মতো দেশে।
- ভুল তথ্য দিলে খাবার জব্দ বা জরিমানার সম্মুখীন হতে পারেন।
- মাংস, দুধ বা অপ্রক্রিয়াজাত খাবার বহনের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে।
রেফারেন্স: EU কাস্টমস নীতিমালা
কোন দেশে কি নেয়া যাবে না?
- বিমানে খাবার বহনের নিয়ম দেশভেদে ভিন্ন। একই খাবার একটি দেশে অনুমোদিত হলেও অন্য দেশে তা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হতে পারে। এ কারণেই বিদেশ ভ্রমণের আগে প্রতিটি দেশের কাস্টমস গাইডলাইন জেনে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার কড়াকড়ি এই তিনটি দেশই জৈব সুরক্ষা আইন কঠোরভাবে মেনে চলে। কাঁচা ফলমূল, সবজি, বীজ, মাংস, দুধজাত খাবার—সব ধরনের অপ্রক্রিয়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। এসব দেশ প্রবেশের সময় যাত্রীদের একটি “Customs Declaration Form” পূরণ করতে হয়, যেখানে এসব পণ্যের উল্লেখ না থাকলে জরিমানা ও জব্দ উভয়ই হতে পারে। (source: [https://www.abf.gov.au/entering-and-leaving-australia/can-you-bring-it-in
- মধ্যপ্রাচ্যের (কুয়েত, সৌদি) নিয়ম: মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হালাল ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তার বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। প্রক্রিয়াজাত খাবার (যেমন টিনজাত, ফ্রোজেন, প্যাকেট) কিছুটা ছাড় পেলেও দুধ, ছানা, বা নিজের রান্না করা খাবার অনেক সময় কাস্টমস আটকে দেয়। সৌদি আরবে অতিরিক্ত শুকনা খাবার নিলে তা সন্দেহজনক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
- বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে যা খেয়াল করবেন বাংলাদেশ থেকে যারা আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ভ্রমণ করেন, বিশেষ করে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান বা ইউরোপের দেশগুলোতে যাচ্ছেন, তাদের উচিত সংশ্লিষ্ট দেশের কাস্টমস ওয়েবসাইট থেকে খাবার বহনের নিয়ম জেনে নেওয়া। অনেক সময় স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় খাবার (যেমন: শুঁটকি, আমসত্ত্ব, মোরব্বা) কড়া নিয়মের আওতায় পড়ে।
আরও জানুন
প্লেনে খাবার বহনের টিপস
- বিমানে খাবার নেওয়ার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখলে যাত্রা হবে ঝামেলামুক্ত ও নিরাপদ।
- সঠিক প্যাকেজিং: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সঠিকভাবে খাবার প্যাক করা। সিল করা প্যাকেট, শক্ত কন্টেইনার, প্লাস্টিক মোড়ানো খাবার বহনের ঝুঁকি কমায়। গন্ধ ছড়ায় না এবং নিরাপত্তা স্ক্যানারেও সমস্যা হয় না।
- খাবারের লেবেল ও উৎস উল্লেখ: যদি সম্ভব হয়, তাহলে খাবারের উপাদান ও উৎস সংক্রান্ত তথ্য লেবেল আকারে যুক্ত করুন। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে নিজের তৈরি খাবার থাকলে, এতে নিরাপত্তা কর্মীরা সন্তুষ্ট হন।
- এয়ারলাইনের ওয়েবসাইট চেক করুন: ভ্রমণের আগে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনের ওয়েবসাইটে গিয়ে “Traveling with food” বা “What you can bring” অংশটি দেখে নেওয়া উচিত। এটি এয়ারলাইনভেদে আলাদা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, Emirates, Qatar Airways বা Biman Bangladesh Airlines-এর নিজস্ব খাদ্য নীতিমালা রয়েছে। (source: https://www.emirates.com/english/help/faq-topics/baggage/traveling-with-food
উপসংহার
বিমানে খাবার নেওয়া সম্ভব হলেও কিছু নিয়ম মেনে চলা অপরিহার্য। প্লেন যাত্রার ধরণ, গন্তব্য দেশ, কাস্টমস ও নিরাপত্তা বিধি সব কিছু বিবেচনায় রেখে খাবার প্যাক ও বহন করতে হবে। ঝামেলা এড়াতে নিষিদ্ধ তালিকা থেকে দূরে থাকুন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও প্যাকেজিং সঠিক রাখুন এবং যাত্রার আগেই তথ্য সংগ্রহ করুন। ভুল তথ্য বা না জানার কারণে বিমানবন্দরে শুধু খাবার ফেলে দেওয়াই নয়, অর্থদণ্ড এমনকি আইনগত সমস্যাও হতে পারে। তাই সচেতন থাকুন, নিরাপদ থাকুন, এবং আকাশযাত্রা হোক স্বস্তিদায়ক।
FAQ
প্রশ্ন ১: বিমানে রান্না করা খাবার নেওয়া যাবে কি?
নিজের রান্না করা খাবার নেওয়া গেলেও নিরাপত্তা ও কাস্টমস কর্মকর্তারা অনেক সময় প্রশ্ন করতে পারেন। তাই পরিষ্কারভাবে প্যাক করা ও উপাদান উল্লেখ থাকলে ভালো।
প্রশ্ন ২: শিশুর দুধ প্লেনে নেওয়া যাবে?
হ্যাঁ, অনুমোদিত সীমায় শিশুর দুধ, বেবি ফুড, ওষুধ প্লেনে নেওয়া যায়। তবে আগেই ঘোষণা করা উচিত।
প্রশ্ন ৩: বিমানে ঝোলজাতীয় খাবার নেওয়া যাবে কি?
না। ১০০ মি.লি. এর বেশি ঝোলজাত খাবার হ্যান্ড লাগেজে নেওয়া যাবে না। চেক-ইনে সীমিতভাবে অনুমোদন থাকে।
প্রশ্ন ৪: প্লেনে খাবার নেওয়া যায় কতটুকু?
ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য সীমিত পরিমাণ অনুমোদিত। তবে কমার্শিয়াল পরিমাণে নিলে কাস্টমস ও শুল্ক আইন প্রযোজ্য হয়।
প্রশ্ন ৫: শুঁটকি মাছ বহন করলে সমস্যা হবে?
শুঁটকি গন্ধযুক্ত হওয়ায় অনেক এয়ারলাইন এতে বাধা দেয়। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে এটি জব্দ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।