আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আপনার সন্তান আগের মতো আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না? কখনো কি মাঝেমধ্যে মাথা ঘোরার কথা বলে? কথা বলতে দেরি করছে? এসব সমস্যা কি মোবাইল বা ট্যাব ব্যবহারের কারণে? এই প্রশ্নগুলো আজ শুধু সচেতন বাবা-মায়ের মনেই নয়, চিকিৎসকদের আলোচনাতেও জায়গা করে নিয়েছে।
আজকের শিশুদের বেড়ে ওঠার সময় প্রযুক্তি জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিদিন শিশুর স্ক্রিনটাইম ৩০ মিনিটের বেশি হলে তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব শিশুর স্ক্রিনটাইম কী, এর ক্ষতিকর প্রভাব, এবং এক নতুন রোগ — ডিজিটাল ভার্টিগো সম্পর্কে, যা অনেক বাবা-মা এখনো জানেন না।
স্ক্রিনটাইম আসলে কী
স্ক্রিনটাইম বলতে বোঝায় আমরা প্রতিদিন কতটা সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, টিভি বা অন্য কোনো স্ক্রিন ডিভাইসের দিকে তাকিয়ে থাকি। এতে শুধু বিনোদনের সময় নয়, পাশাপাশি শিক্ষামূলক ভিডিও দেখা, গেম খেলা বা অনলাইনে ক্লাস করার সময়ও এর অন্তর্ভুক্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস (AAP) স্ক্রিন টাইমের একটি গাইডলাইন দিয়েছে। তাদের মতে, দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য স্ক্রিন টাইম একেবারে নিষিদ্ধ। দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য দিনে এক ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন নয়। বড়দের ক্ষেত্রেও দিনে দুই ঘণ্টার বেশি স্ক্রিনে না থাকাই স্বাস্থ্যকর।
সব স্ক্রিন টাইম কিন্তু আবার এক নয়। পজিটিভ স্ক্রিন টাইম যেমন—শিক্ষামূলক ভিডিও বা পরিবারের সাথে একসাথে কিছু দেখা—শিশুর বিকাশে কাজে লাগতে পারে। কিন্তু যখন শিশুর স্ক্রিনটাইম বেশি হয় একা বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইউটিউব বা কার্টুন দেখে, তখন সেটি হয়ে যায় নেতিবাচক স্ক্রিন টাইম।
ভালো স্ক্রিনটাইম বনাম খারাপ স্ক্রিনটাইম
স্ক্রিন টাইমের ধরন | ভালো স্ক্রিনটাইম | খারাপ স্ক্রিনটাইম |
---|---|---|
সময় | নির্ধারিত ও সীমিত | ঘণ্টার পর ঘণ্টা |
সহযোগিতা | বাবা-মা সঙ্গে আছে | শিশু একা |
বিষয়বস্তু | শিক্ষামূলক, বয়স উপযোগী | র্যান্ডম কার্টুন বা ভিডিও |
প্রতিক্রিয়া | শিশু প্রশ্ন করছে বা প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে | কেবল বসে থাকা ও চুপ থাকা |
উদ্দেশ্য | শেখা, যোগাযোগ তৈরি | সময় পার করা |
শিশুর অতিরিক্ত স্ক্রিনটাইমের প্রভাব
প্রতিদিন দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার ফলে আমাদের শরীর ও মনে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। সবচেয়ে আগে প্রভাব পড়ে চোখে। নীল আলো চোখের অভ্যন্তরীণ কোষগুলোতে ক্ষতি করে। চোখ শুষ্ক হয়ে যায়, ব্যথা করে এবং ঝাপসা দেখার সমস্যা শুরু হয়।
স্ক্রিনের আলো ও মস্তিষ্কের ঘুম হরমোনের মধ্যে গোলমাল তৈরি করে। ফলে রাতে ঘুমে সমস্যা হয়, এবং সকালে ক্লান্তি কাটে না। আবার, সারাদিন স্ক্রিনে বসে থাকলে শারীরিক গতিশীলতা কমে যায়, ওজন বাড়ে এবং ঘাড় ও পিঠে ব্যথা শুরু হয়।
শিশুর অতিরিক্ত স্ক্রিনটাইমের প্রভাব আরও ভয়াবহ। অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমের কারণে তারা কথা বলা শিখতে দেরি করে। কারণ স্ক্রিন থেকে তারা একমুখী তথ্য পায়, কিন্তু যোগাযোগ শেখে না।
আপনার সন্তান কি দেরিতে কথা বলা শুরু করেছে? এটা হয়তো স্ক্রিন টাইমের সরাসরি প্রভাব।
📚 আরো পড়ুন:
ডিজিটাল ভার্টিগো কী এবং কেন হয়
ডিজিটাল ভার্টিগো এমন একটি শারীরিক অবস্থা, যা সাধারণত দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার ফলে ঘটে। এতে মাথা ঘোরা, ভারসাম্য হারানো বা অস্বাভাবিক ক্লান্তি দেখা দেয়।
এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে ভার্চুয়াল মোশন সিকনেসের কথা বলতে হয়। ধরুন, আপনি স্ক্রিনে একটি দ্রুতগতির ভিডিও দেখছেন, কিন্তু আপনার শরীর স্থির। মস্তিষ্ক ঠিকভাবে বুঝতে পারছে না আপনার শরীর স্থির নাকি গতিশীল? এই সিগন্যাল কনফ্লিক্ট থেকে মাথা ঘোরা বা ভার্টিগোর অনুভূতি তৈরি হয়।
এর সঙ্গে আছে চোখের পেশির ক্লান্তি। যখন শিশু বা বড় কেউ একটানা ঘন্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনে তাকায়, তখন চোখের পেশিতে চাপ পড়ে। আবার, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা মানে শরীর ও মস্তিষ্ক দুটোরই একঘেয়েমি—এর ফলে মানসিক ক্লান্তি তৈরি হয়। সব মিলিয়ে শরীর আর মস্তিষ্কে যে বিভ্রান্তির জন্ম দেয় তাই ডিজিটাল ভার্টিগোর। সোর্স
ডিজিটাল ভার্টিগোর লক্ষণ কি কি?
ডিজিটাল ভার্টিগোর সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো মাথা ঘোরা। শিশু বা বড় কেউ যদি ঘন ঘন এমন অনুভব করে, তাহলে বিষয়টি হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। ভারসাম্য হারানো, চোখে যন্ত্রণা, ঝাপসা দেখা এবং মাঝে মাঝে বমি বমি ভাবও এই সমস্যার লক্ষণ।
আপনার বাচ্চা কি মাঝে মাঝে হঠাৎ মাথা ঘোরার কথা বলে? তাহলে এখনই সতর্ক হোন। অনেক সময় স্কুলে মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা বা হঠাৎ হতাশ অনুভব করাও এই রোগের প্রভাব হতে পারে।
মার্কিন স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা Mayo Clinic এবং National Eye Institute-এর গবেষণায় এসব তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের মতে, দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার কারণে চোখ, মস্তিষ্ক ও অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য ব্যবস্থায় সংকট তৈরি হয়।
এই সমস্যা নিরসনে প্রথম পদক্ষেপ হলো সচেতনতা। অনেক সময় বাবা-মা ভাবেন, বাচ্চা চুপচাপ বসে ভিডিও দেখছে—তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা না জানলে সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।
শিশুর স্ক্রিনটাইম ৩০ মিনিটের বেশি হলে ৫ টি বিপদ
১. ভাষার বিকাশে দেরি হয়
দুই থেকে তিন বছরের শিশুদের শেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। তারা কথা বলা শেখে, আবেগ প্রকাশ করে, বিভিন্ন শব্দ উচ্চারন করা শেখে। কিন্তু স্ক্রিনে একমুখী তথ্য পেয়ে তারা যোগাযোগ শেখে না। ফলে শিশুরা অনেক সময়েই নির্দিষ্ট বয়সে কথা বলতে পারে না। এই তথ্য বারবার উঠে এসেছে Child Mind Institute ও AAP-এর গবেষণায়।
২. একমুখী যোগাযোগ → কম সামাজিক দক্ষতা
শিশু যখন মানুষের বদলে স্ক্রিনের সাথে সময় কাটায়, তখন বাস্তব জীবনের পারস্পরিক যোগাযোগ কমে যায়। এতে তাদের সামাজিক দক্ষতা তৈরি হয় না। বন্ধু বানানো, বড়দের সঙ্গে কথা বলা কিংবা ক্লাসে প্রশ্ন করা—এসব বিষয়েও তারা পিছিয়ে পড়ে।
৩. শেখার আগ্রহ কমে যাওয়া
স্ক্রিনের ফাস্ট কন্টেন্ট শিশুদের মস্তিষ্কে তাত্ক্ষণিক আনন্দ দেয়। ফলে ধৈর্য ধরে বই পড়া বা ক্লাসে মনোযোগ দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ধীরে শেখার প্রতি বিরক্তি তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞরা একে বলে “attention deficit”—যা পরে ADHD’র ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. বেশি মুড সুইং ও ধৈর্যহীনতা
ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনে থাকলে শিশুর মেজাজ হঠাৎ বদলে যায়। রাগ, কান্না, হাসি—সবই অনিয়ন্ত্রিত হয়। স্ক্রিন বন্ধ করলেই তারা চিৎকার করে, যেকোনো কাজ শেষ করতে চায় না।
৫. বাবা-মা–সন্তানের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি
বেশিরভাগ সময় মা-বাবারাও ব্যস্ত থাকেন ফোনে। ফলে সন্তান এবং অভিভাবকের মধ্যে কথা হয় কম, চোখে চোখ রেখে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। এই দূরত্ব ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে—বিশেষত কিশোর বয়সে।
কীভাবে স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণে আনবেন
স্ক্রিন বাদ দেওয়া কঠিন হতে পারে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। নিচের টিপসগুলো শুধু শিশুর জন্য নয়, বরং পুরো পরিবারের জন্য কার্যকর।
১. ২০-২০-২০ নিয়ম মেনে চলুন
প্রতি ২০ মিনিট স্ক্রিনে তাকানোর পর, ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরের কোনো কিছু দেখানো বা দেখার অভ্যাস তৈরি করুন। এটি চোখ ও মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়।
২. বয়স অনুযায়ী স্ক্রিনটাইম নির্ধারণ করুন
WHO এবং AAP যেসব সময়সীমা নির্ধারণ করেছে, সেটি মেনে চলুন। এক বছরের নিচে কোনো স্ক্রিন নয়, দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে দিনে এক ঘণ্টা সর্বোচ্চ।
বয়স | সর্বোচ্চ স্ক্রিন টাইম |
---|---|
২ বছরের নিচে | শূন্য |
২–৫ বছর | সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা |
৬–১৮ বছর | সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা |
প্রাপ্তবয়স্ক | ২ ঘণ্টার কম |
৩. খাবার ও ঘুমের আগে স্ক্রিন নয়
রাতের ঘুম শুরুর আগে অন্তত এক ঘণ্টা স্ক্রিন ব্যবহার বন্ধ রাখুন। একইভাবে খাওয়ার সময় ফোন বন্ধ রাখুন, বরং খাবারের রং, গন্ধ ও স্বাদের বিষয়ে শিশুর সাথে কথা বলুন।
৪. স্ক্রিন + বাবা–মা = ভালো শেখার সুযোগ
যদি স্ক্রিন ব্যবহার হয়, তাহলে সেটা হোক অভিভাবকের সঙ্গে মিলে। একসঙ্গে ভিডিও দেখা, প্রশ্ন করা, রং কিংবা শব্দ ব্যাখ্যা করাই শিশুর শেখার সেরা সুযোগ।
৫. শিশুকে স্ক্রিণ ব্যাতীত অন্য কোন কাজে ব্যস্ত রাখুন
বাচ্চাদের হাতে খেলনা দিন, তাদের সঙ্গে গল্প বলুন, রঙ তুলিতে ছবি আঁকতে দিন, বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করুন। এসব অভ্যাসে মনোযোগ বাড়ে ও স্ক্রিন আসক্তি কমে।
📋 বাবা–মার জন্য সচেতনতার ৫টি চেকলিস্ট
- ✅ আপনি নিজে কি স্ক্রিন আসক্ত?
আপনি যদি দিনভর ফোনে থাকেন, তাহলে সন্তানও সেটা শিখবে। শিশুর সামনে ফোন কম ব্যবহার করুন। - ✅ কোয়ালিটি টাইমে ফোন দূরে রাখুন
সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানোর সময় ফোন পাশে রাখুন না। চোখে চোখ রেখে কথা বলুন, গল্প করুন। - ✅ সন্তান যা দেখছে তা নিয়ে আলাপ করুন
ভিডিওতে কি দেখছে? কেন দেখছে? এই বিষয়গুলো নিয়ে শিশুকে প্রশ্ন করুন। এতে তাদের ভাবনা ও শব্দ জ্ঞান বাড়ে। - ✅ একসঙ্গে স্ক্রিন দেখে ব্যাখ্যা করুন
যেমন টিভিতে “আপেল” দেখলে তাকে বলুন—লাল রঙের, গোল আকারের, মিষ্টি ফল। এতে শিখে নেওয়া হয় গভীরভাবে। - ✅ একটি স্ক্রিন-ফ্রি জোন রাখুন
ঘরের একটি জায়গা নির্ধারণ করুন যেখানে কেউ ফোন আনবে না। এখানে গল্প, খেলা বা খাবার হবে একসাথে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন
নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে আর দেরি নয়।
১. প্রতিদিন মাথা ঘোরা বা ভারসাম্য হারানো
২. শিশু যদি ঘুমে সমস্যা করে বা কথা শেখায় দেরি হয়
৩. চোখে ব্যথা বা ঝাপসা দেখা শুরু হলে
৪. বাচ্চা যদি দীর্ঘ সময় বিষণ্ন থাকে বা বারবার মুড সুইং হয়
শেষ কথা, এই সমস্যাগুলো নতুন হলেও সমাধান সম্ভব। সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে চাইলে আজ থেকেই সচেতন হোন। আপনার ছোট পদক্ষেপ একদিন বড় পার্থক্য গড়ে তুলতে পারে।