১৭ মে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। এই দিনটি সাধারণত মানুষকে সচেতন করার জন্য পালিত হয়। তবে শুধু একটি দিনের সচেতনতা যথেষ্ট নয়। কারণ, উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপ্রেশার এমন একটি নীরব ঘাতক, যা চুপিচুপি শরীরের বড় ক্ষতি করে ফেলতে পারে—আপনার বুঝে ওঠার আগেই। এক সময় মনে করা হতো হাইপ্রেশার মূলত বয়স্কদের রোগ। কিন্তু সময় পাল্টেছে। এখন বয়স ৩৫ এর নিচে হাইপ্রেশার হলে কি করতে হবে তা নিয়ে সচেতনতা করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি ৪ জনে ১ জন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। ২০১৭–১৮ সালের ‘বাংলাদেশ জনমিতি স্বাস্থ্য জরিপ’ অনুযায়ী, এই হার ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ হাইপ্রেশারজনিত কারণে মারা যাচ্ছেন।
উচ্চ রক্তচাপ কী/ হাই প্রেশার হলে কিভাবে বুঝবেন?
উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেশার মানে হলো—আপনার রক্ত ধমনীর মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করছে। এই চাপ যদি নিয়মিত বেশি থাকে, তাহলে এটি আপনার হার্ট, কিডনি, চোখ, এমনকি মস্তিষ্কের উপর দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
রক্তচাপ কিভাবে মাপা হয়?
রক্তচাপ মাপা হয় দুটি সংখ্যায়:
- সিস্টোলিক প্রেশার (উপরের সংখ্যা):যখন হৃৎপিণ্ড রক্ত পাম্প করে।
- ডায়াস্টোলিক প্রেশার (নিচের সংখ্যা): যখন হৃৎপিণ্ড বিশ্রামে থাকে।
রক্তচাপের স্বাভাবিক মাত্রা
ক্যাটাগরি | সিস্টোলিক (উপরের চাপ) | ডায়াস্টোলিক (নিচের চাপ) |
---|---|---|
স্বাভাবিক | কম ১২০ | কম ৮০ |
সতর্ক অবস্থান | ১২০–১২৯ | কম ৮০ |
হাইপ্রেশার স্টেজ ১ | ১৩০–১৩৯ | বা ৮০–৮৯ |
হাইপ্রেশার স্টেজ ২ | ১৪০ বা বেশি | বা ৯০ বা বেশি |
দ্রষ্টব্য: যদি পরপর কয়েকবার রক্তচাপ ১৪০/৯০ বা তার বেশি হয়, তবে ধরে নেওয়া যায় যে আপনি হাইপ্রেশারে আক্রান্ত।
উচ্চ রক্তচাপের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো—এটির সাধারণত কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ থাকে না।
হাইপ্রেশার হলেই মাথাব্যথা হবে?
ভুল ধারণা! অনেকেই মনে করেন, হাইপ্রেশার হলে মাথাব্যথা বা মাথা ঘোরা লাগবে। কিন্তু অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণই দেখা যায় না। তবে কারও কারও মধ্যে নিচের উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে:
- হঠাৎ মাথা ঘোরা বা ভার ভার লাগা
- বুক ধড়ফড় করা বা অস্থির লাগা
- মাথাব্যথা বা বমি বমি ভাব
- রাতে ঘুমের সমস্যা বা ক্লান্তিভাব
- চোখে ঝাপসা দেখা বা কানে শব্দ হওয়া
এই উপসর্গগুলো দেখা দিলে দ্রুত রক্তচাপ পরীক্ষা করা উচিত।
হাইপ্রেশারের কারণ:
- ৯৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই এ ধরণের হাইপ্রেশারকে বলা হয় প্রাইমারি বা এসেনশিয়াল হাইপারটেনশন। এটি ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, এবং মূলত আমাদের জীবনযাপন ও অভ্যাস এর জন্য দায়ী। হাইপ্রেশার বাড়ায় এমন ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস বা অবস্থা:
- অতিরিক্ত লবণ খাওয়া: প্রতিদিন ৬ গ্রামের বেশি লবণ গ্রহণ করলে হাইপ্রেশার বাড়ে।
- ওজন বেড়ে যাওয়া: স্থূলতা উচ্চ রক্তচাপের একটি বড় কারণ।
- ধূমপান ও মদ্যপান: রক্তনালী শক্ত হয়ে যায় ও চাপ বাড়ে।
- স্ট্রেস বা মানসিক চাপ: উদ্বেগে থাকলে হৃদস্পন্দন বাড়ে ও প্রেশার ওঠে।
- ঘুমের সমস্যা: রাতে কম ঘুম হলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে।
- পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের কারও থাকলে আপনার ঝুঁকি বাড়ে।
> বিশেষ সতর্কতা: গর্ভবতী নারীদের, কিডনি বা থাইরয়েড রোগীদের হাইপ্রেশার হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি।
ছোট্ট পরামর্শ: যদি আপনার বয়স ৩০-এর বেশি হয়, অন্তত বছরে একবার রক্তচাপ মেপে দেখুন।
রক্তচাপ কমাবেন কিভাবে?
মাথাব্যথা বা দুর্বলতা অনুভব করলে প্রেশার মাপুন। ফার্মেসিতে নয়, পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে মাপানোই ভালো। জীবনযাপনের পরিবর্তনে হাইপ্রেশার কন্ট্রোল সম্ভব! উচ্চ রক্তচাপ কোনো অনিবার্য রোগ নয়। আপনি যদি আজ থেকেই কয়েকটি পরিবর্তন আনেন আপনার দৈনন্দিন জীবনে, তাহলে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব।
- পাতে লবণ বাদ দিন লবণের মধ্যে থাকা সোডিয়াম রক্তে জলীয় অংশ বাড়িয়ে তোলে, ফলে রক্তনালীর উপর চাপ বেড়ে যায়। চিকিৎসকরা বলেন, প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫–৬ গ্রাম (১ চা চামচের কম) লবণ গ্রহণ করা উচিত। পাতে আলাদা লবণ দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।
- হাঁটুন, শরীর সচল রাখুন: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটাহাঁটি করুন। সপ্তাহে কমপক্ষে ৫ দিন এই অনুশীলন চালিয়ে যান। হাঁটলে শুধু প্রেশার কমে না, ওজনও নিয়ন্ত্রণে আসে, স্ট্রেস কমে, হার্ট ভালো থাকে
- লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন, বসে বসে কাজ কমান।
- ধূমপান ও মদ্যপান ছেড়ে দিন: ধূমপান রক্তনালীকে শক্ত করে তোলে, যা রক্তচাপ বাড়ায়। এলকোহল বা অতিরিক্ত চা–কফির কারণে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। ধূমপান ছাড়লে শুধু প্রেশারই নয়, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও কমে।
- ঘুম ভালো না হলে ব্লাড প্রেসারও ভালো থাকবে না পর্যাপ্ত ও গাঢ় ঘুম মানে, আপনার শরীর বিশ্রাম পাচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ৭–৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। যারা রাতে ঘুমাতে পারেন না বা বারবার জেগে যান, তাদের মধ্যে হাইপ্রেশার হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ। –
২০১৯ সালের একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, হাইপ্রেশার হলে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওষুধ খেলে তা দিনের তুলনায় বেশি কার্যকর হতে পারে। তবে নিজের মতো করে সময় পরিবর্তন করবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কিছু নয়।
হাইপ্রেশার এর ওষুধ খেতে ভুলে গেলে কী করবেন?
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ধরে ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। ওষুধ এমন জায়গায় রাখুন যেখানে চোখে পড়ে—যেমন, খাবারের টেবিলে। ভুলে গেলে, মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে ফেলুন (যদি খুব দেরি না হয়ে যায়)
ওষুধের আগে চেষ্টা করুন এই ৫ ঘরোয়া পদ্ধতি
রক্তচাপ কমানোর খাবার
উপাদান | কিভাবে সাহায্য করে |
---|---|
রসুন | কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, রসুন রক্তনালীর প্রসারণ ঘটিয়ে রক্তচাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে। |
কলা | পটাশিয়াম সমৃদ্ধ কলা শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। |
মেডিটেশন বা শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ | স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমিয়ে প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। |
গ্রিন টি | গ্রিন টিতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রক্তচাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে। |
ফলমূল ও শাকসবজি | ফাইবার ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে ও হৃদ্স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। |
দ্রষ্টব্য: এগুলো প্রেশার কমাতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু কখনোই চিকিৎসকের বিকল্প নয়। সমস্যা স্থায়ী হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
নিয়মিত রক্তচাপ মাপা কেন এত জরুরি?
রক্তচাপ কখন বাড়ছে বা কমছে তা জানতেই নিয়মিত প্রেশার মাপা জরুরি। এটি আপনাকে অল্পতেই ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ দেয়।
- ১৮–৪০ বছর: প্রতি ১–২ বছর অন্তর
- ৪০ বছরের বেশি: প্রতি ৬ মাসে একবার
- যদি হাইপ্রেশার থাকে: প্রতি ১৫–৩০ দিন অন্তর, অথবা চিকিৎসকের নির্দেশ অনুসারে
তেঁতুল শরবত খেলে কি হাইপ্রেশার কমে?
তেঁতুল, পুদিনা শরবত বা বরফ দিয়ে মাথা ধোয়া – এগুলো বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান নয়। ভুল পদ্ধতিতে সময় নষ্ট করলে বিপদ আরও বাড়ে।
দ্রুত প্রশ্নোত্তর (FAQ)
১. আমার বয়স ৩৫, এখনও রক্তচাপ মাপি না। শুরু করব কেন?
হাইপ্রেশার এখন ৩০-৩৫ বছরেই শুরু হয়। লক্ষণ না থাকলেও শরীরের ক্ষতি হচ্ছে—তাই আগেভাগে সতর্ক হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
২. ওষুধ ছাড়া হাইপ্রেশার ঠিক করা কি সম্ভব?
👉 অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব। ওজন কমানো, লবণ নিয়ন্ত্রণ, হাঁটাহাঁটি, মানসিক চাপ কমালে ওষুধ ছাড়াই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি।
৩. আমি শুধু স্ট্রেসে পড়লেই প্রেশার বাড়ে। এটা কি বিপদজনক?
👉 হ্যাঁ। মানসিক চাপ থেকেও দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী হাইপ্রেশার হতে পারে।
৪. ঘুম কেমন হলে প্রেশার বাড়ে?
👉 রাতে ৬ ঘণ্টার কম ঘুম, বারবার জেগে যাওয়া, ঘুমে শ্বাস বন্ধ হওয়া (স্লিপ অ্যাপনিয়া) – এগুলো হাইপ্রেশারের বড় কারণ।
৫. লো প্রেশার আর হাই প্রেশার—দুটো একসঙ্গে হয় নাকি?
👉 না। তবে প্রেশার ওঠানামা করলে সেটা ল্যাবাইল হাইপারটেনশন হতে পারে—চিকিৎসা প্রয়োজন।
৬. গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেশার হলে কী করব?
👉 সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া বা গর্ভকালীন জটিলতা