বাংলাদেশের বিনোদন জগতে এক অনন্য নাম হানিফ সংকেত। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছেন। হানিফ সংকেতের ইত্যাদি বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু কীভাবে তিনি হানিফ সংকেত হলেন?
হানিফ সংকেতের পড়াশোনা
হানিফ সংকেতের জন্ম ১৯৫৮ সালে ঢাকায়। ছোট থেকেই তিনি কিছুটা কৌতুকপ্রবণ এবং সৃষ্টিশীল ছিলেন। বই পড়ার অভ্যাস পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। এই অভ্যাস পরবর্তীতে তাঁকে একজন দক্ষ উপস্থাপক ও লেখক হতে সাহায্য করে। কিশোর থেকেই বিতর্ক প্রতিযোগিতা, অভিনয় এবং নাটকে অংশগ্রহণ করেন তিনি। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অবদান ছিল চোখে পরার মত।
হানিফ সংকেতের নাটক
হানিফ সংকেতের টেলিভিশন যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে। তার অভিনীত নাটক এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
১. ‘কুসুম’ – পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ।
২. ‘আগমন’ (১৯৮৮)- খলনায়কের ভূমিকায়।
৩. ‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ’।
৪. ‘ঢাকা-৮৬’।
এছাড়া এ জে মিন্টু পরিচালিত ‘প্রথম প্রেম’ চলচ্চিত্রে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। গানের প্রথম কথা– ‘তু তু তু তু তু তা রা মর্জিনার বাপ মার্কামারা’।
লেখা বই
১৯৯৫ সালে শ্রদ্ধেয় রাজধানী নামক বই লিখে তার হাতেখড়ি হয়। এর পর থেকে তিনি ১৭ টি বই লিখেছেন। যার মধ্যে আটখানার পাটখানা, বিনীত নিবেদন, হামানদিস্তা, রঙ্গ বিরঙ্গ, কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং গণ্য মান্য সামান্য বইগুলো অন্যতম। বইগুলো অনন্যা প্রকাশনী, স্টুডেন্ট ওয়েজ এবং মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত।
হানিফ সংকেতের উপস্থানা
তিনি মূলত নাটক ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচিতি পান। বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘জিজ্ঞাসা’-তে কাজ করার সুযোগ পান। এখান থেকেই তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি মেলে এবং তখনই দর্শকদের মন জয় করতে শুরু করেন।
হানিফ সংকেতের ইত্যাদি
বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন ম্যাগাজিন ‘ইত্যাদি’ প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৮৯ সালে। ইত্যাদি প্রথম পর্বেই দর্শকদের মনে জায়গা করে নেয়। এই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল সামাজিক ব্যঙ্গাত্মক ছোট নাটিকা, দর্শকদের অংশগ্রহণ এবং শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান। এটি সাধারণ বিনোদনের চেয়ে অনেক বেশি ছিল, যা দর্শকদের বাস্তব জীবনের নানা দিক সম্পর্কে সচেতন করত। আরো জানুনঃ কেন মোনালিসার আসল ছবি সরানো হচ্ছে লুভর থেকে?
কীভাবে ইত্যাদি একটি জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হলো?
নিয়মিত নতুন ও বৈচিত্র্যময় বিষয়বস্তু এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুটিং এর মাধ্যমে ইত্যাদি বিখ্যাত হতে থাকে। গত ৩০ বছর ধরে চলে আসা ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি সমাজের নানা অসংগতির বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠ রাখেন। বিবিসিসহ দেশের প্রতিটি জরিপেই দেখা গেছে, ইত্যাদি দেশের সেরা টিভি অনুষ্ঠান এবং দেশের ৭৫ শতাংশ টিভি দর্শক এই অনুষ্ঠান দেখে থাকে।
ইত্যাদি কবে হবে?
ইত্যাদি বর্তমানে এটি তিন মাস অন্তর অন্তর বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। সাধারণত একটি নতুন ইত্যাদি মাসের পঞ্চম শুক্রবার রাত ৮ টার বাংলা সংবাদের পর এবং সংকলিত ইত্যাদি প্রতি মাসের প্রথম রবিবার রাত ১০ টার ইংরেজি সংবাদের পর সম্প্রচার করা হয়। এছাড়া প্রতি বছর ঈদ-উল-ফিতর এর পরদিন রাত ১০ টার ইংরেজি সংবাদের পরেও অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয়।
হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ প্রতিবারের মতোই নতুন পর্বের শুটিং করতে গিয়েছিল ঠাকুরগাঁওয়ে। তবে এবারের পর্ব নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে আলোচনার ঝড়। প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে শুটিং বন্ধ করতে বাধ্য হন হানিফ সংকেত ও তাঁর টিম। এই ঘটনা নিয়ে দর্শকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। কী হয়েছিল সেদিন? কেন শুটিং বন্ধ হলো?
‘ইত্যাদি ২০২৫ এর পর্বে শুটিং এর জন্য ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহাসিক স্থান নির্বাচন করা হয়। অনুষ্ঠানটির জনপ্রিয়তার কারণে আগেই প্রচার হয়েছিল যে এখানে শুটিং হবে। ফলে হাজারো দর্শক সেখানে উপস্থিত হয়। সরাসরি সেটে উপস্থিত থাকার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি ভক্তরা। অনেকেই ভেবেছিল অনুষ্ঠানে দর্শক হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে, তাই তারা আগেভাগেই চলে আসে।
অনুমানের চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দর্শকসংখ্যা এত বেশি ছিল যে শুটিং পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে শুটিং বন্ধ করার পরামর্শ দেন।
শুটিং বন্ধ হওয়ার পর হানিফ সংকেত একটি বার্তা দেন, যেখানে তিনি বলেন—
“আমরা সবসময় দর্শকদের ভালোবাসার মূল্য দেই। কিন্তু যখন সেটি নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠে, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে যায়।”
দেশি-বিদেশি স্বীকৃতি
জাতীয় পুরস্কার সহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন হানিফ সংকেত।
- সামাজিক কার্যক্রমের জন্য হানিফ সংকেত, ২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১০ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত হন।
- পরিবেশ শিক্ষা ও প্রচারের জন্য ২০১৪ সালের জাতীয় পরিবেশ পদক পান।
- ২০০৫ সালে মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পান।
ইত্যাদিতে ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
গত ০১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘ইত্যাদি’-তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ভারতীয় সাংবাদিক ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে বিতর্কিত হয়ে ওঠেন এই সাংবাদিক।
কালো কোর্ট পড়া এক ব্যক্তি কখনো হাঁটছেন, কখনো দৌড়াচ্ছেন, কখনো মিথ্যা গুজব ছড়াচ্ছেন। এমনকি “বাংলাদেশ থাকবে না” -এর মতো উদ্ভট মন্তব্য করছেন। দর্শকরা সহজেই বুঝতে পারেন, এটি মূলত রিপাবলিক বাংলার সাংবাদিক ময়ূখ রন্জ্ঞন ঘোষ। আর তাকে ব্যঙ্গ করেই তৈরি করা হয়েছে ইত্যাদিতে এপিসোড। উদ্ভট আচরণ, অঙ্গভঙ্গিতে অনুষ্ঠান চলাকালীনই দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়েন, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে।