বিমান দুর্ঘটনা একটি ভয়াবহ ঘটনা যা যাত্রীদের জীবন, সম্পত্তি এবং পরিবহণ শিল্পের প্রতি ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি দুর্ঘটনার পরিমাণ অনেক কমেছে, তবে এর প্রকৃতি এবং পরিণতি কিছুতেই অস্বীকারযোগ্য। এই প্রবন্ধে, আমরা গত ১০ বছরে ঘটানো বিমান দুর্ঘটনাগুলি, তাদের কারণ এবং ব্ল্যাক বক্সের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব।
বিগত ১০ বছরে বড় বিমান দুর্ঘটনা এবং তার কারণ
দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান দুর্ঘটনা
২৯ ডিসেম্বর, দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হয়, যার ফলে ১৭৯ জন নিহত হন। বিমানটি ছিল জিজু এয়ারের, যা থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে ফিরছিল। এই বিমানটি অবতরণের সময় রানওয়ের গিয়ার (চাকা) সমস্যায় পড়ে এবং দুর্ঘটনাটি ঘটতে পারে। মাটিতে অবতরণের সময় বিমানটি পিছলে যাওয়ার কারণেই এটি বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনার পর দুই জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে এ ঘটনা পাখির আঘাতের কারণে।
নরওয়ের অসলোতে জরুরি অবতরণ
নরওয়ের রাজধানী অসলোতে একটি যাত্রীবাহী বিমান জরুরি অবতরণ করে। আমস্টারডামগামী এই বিমানটি ১৮০ জনেরও বেশি যাত্রী নিয়ে হাইড্রোলিক ত্রুটির কারণে টর্প বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। বিমানের বাম দিকের ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়, তাই পাইলটরা দমকল বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার জন্য কন্ট্রোল রুমে নির্দেশ দেন। তবে সৌভাগ্যক্রমে, বিমানে থাকা ১৮২ জনের কেউই আহত হননি। আরো জানুন: সস্তায় বিমান টিকেট কাটবো কিভাবে?
কানাডায় রানওয়েতে আগুনের দুর্ঘটনা
কানাডার হ্যালিফ্যাক্স বিমানবন্দরে এয়ার কানাডার এসসি২২৫৯ বিমানটি অবতরণের সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে যায় এবং এতে আগুন ধরে যায়। সেন্ট জন’স থেকে হালিফাস্কে আসা এই বিমানে কোনও বড় ক্ষতি না হলেও, এই দুর্ঘটনা একে অন্যকে সাবধান হতে শিখিয়েছে।
MH370 – মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের বিমান অদৃশ্য
মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট MH370 ২০১৪ সালে কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়ে যায়। এই দুর্ঘটনা আজও রহস্যময়। বিমানটির যে কোনো ধরনের ত্রুটি বা দুর্ঘটনার কারণ জানা যায়নি, তবে বিভিন্ন তত্ত্ব অনুযায়ী এটি একটি প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলস্বরূপ ঘটে থাকতে পারে। এ নিয়ে জনপ্রিয় স্ট্রিমিং প্লাটফর্ নেটফ্লিক্সে একটি ডকুমেন্ট্রিও আছে।
Ethiopian Airlines 302 – Boeing 737 MAX দুর্ঘটনা
২০১৯ সালে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৩০২, যেটি বোয়িং 737 MAX মডেলের বিমান ছিল, সেটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। বিমানের MCAS (Maneuvering Characteristics Augmentation System) সিস্টেমের ত্রুটির কারণে এটি বিধ্বস্ত হয় এবং ১৫৭ জন নিহত হয়।
Germanwings 9525 – সহ-পাইলটের আত্মহত্যা
২০১৫ সালে জার্মানউইংস ফ্লাইট ৯৫২৫, যে বিমানটির পাইলটের আত্মহত্যার কারণে এটি দুর্ঘটনায় পড়ে, ১৫০ জনের মৃত্যু হয়। এটি বিমান নিরাপত্তা সম্পর্কিত সবচেয়ে আতঙ্কজনক ঘটনাগুলির একটি। আরো জানুন: Turkish Airlines এর এক পাইলট মৃত আকাশপথে
এই দুর্ঘটনাগুলির পাশাপাশি, ১০ বছরে আরও বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটে যা বিমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অবস্থা তুলে ধরেছে।
বিমান দুর্ঘটনার কারণ
প্রযুক্তিগত ত্রুটি
বিমান দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ প্রযুক্তিগত ত্রুটি। এই ধরনের ত্রুটির কারণে অনেক সময় বিমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন ইঞ্জিন, কন্ট্রোল সিস্টেম বা ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার বিঘ্নিত হতে পারে, যা দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।
মানবিক ত্রুটি
এটি আরেকটি সাধারণ কারণ। পাইলট বা ক্রু সদস্যদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। উড্ডয়ন, অবতরণ বা বিমান পরিচালনায় ভুল বুঝাবুঝি এবং অপারেশনাল ত্রুটি এর মধ্যে অন্যতম।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব
আবহাওয়ার কারণে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটে, বিশেষ করে ঝড়, তুষারপাত বা ঘন কুয়াশার কারণে অনেক সময় বিমান পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি
বিমান সংস্থার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, যেমন নিরাপত্তা প্রোটোকল অনুসরণ না করা বা জরুরি পরিস্থিতির জন্য যথাযথ প্রস্তুতির অভাব। আরো পড়ুন : শাহজালাল আন্তজার্তিক বিমানবন্দরের সাম্প্রতিক পরিবর্তন সমূহ
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স দুর্ঘটনা পরিসংখ্যান
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে গত কয়েক বছরে কিছু ছোট-মাঝারি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল
- মুজিবনগর বিমান দুর্ঘটনা (১৯৭৭)
- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট BG147 (২০১৪)
- ঈদে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কাছে বিমানের রানওয়েতে দুর্ঘটনা (২০২১)।
- US-Bangla Airlines Flight 211 (২০১৮): নেপালের কাঠমান্ডুতে অবতরণের সময় এই ফ্লাইটটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়, যাতে ৪৯ জন নিহত হন। পরবর্তীতে তদন্তে পাইলটের ভুল এবং কন্ট্রোল টাওয়ারের নির্দেশনার অসঙ্গতি দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
আরো জানুন: এয়ার ইন্ডিয়ার ছয়টি ফ্লাইটে বোমা হুমকি
বাংলাদেশের বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি
বাংলাদেশ বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করার চেস্টা করছে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মানদণ্ড অনুসরণ করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB) নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করছে। সেবার মানোন্নয়নের পাশাপাশি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং অন্যান্য বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর নিরাপত্তা বিষয়ক পরিদর্শন ও মানদণ্ড কঠোর করার দিকেও নজর দেয়ার জন্য অভিজ্ঞরা পরামর্শ দেন।
বিমান ভ্রমণ কতটা নিরাপদ?
বিমান ভ্রমণ পৃথিবীর অন্যতম নিরাপদ পরিবহন মাধ্যম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) অনুযায়ী, বিমান দুর্ঘটনার হার প্রতি এক লাখ যাত্রীর মধ্যে মাত্র ০.০৫ দুর্ঘটনা। এটি অন্যান্য পরিবহণের তুলনায় অনেক কম।
কি থাকে বিমানের ব্ল্যাকবক্সে?
ব্ল্যাক বক্স, যা ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (FDR) এবং ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (CVR) নিয়ে গঠিত, বিমান দুর্ঘটনার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুর্ঘটনার সময় বিমান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে ব্ল্যাক বক্স ব্যবহার করা হয়।
উপসংহার
বিমান দুর্ঘটনা আজও একটি ভয়াবহ বাস্তবতা, তবে প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এই দুর্ঘটনার হার কমে এসেছে। ব্ল্যাক বক্সের মতো প্রযুক্তির সহায়তায় দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়, যা ভবিষ্যতে আরও নিরাপদ বিমান ভ্রমণ নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
প্রশ্নোত্তর (FAQ)
১. ব্ল্যাক বক্স কীভাবে কাজ করে?
ব্ল্যাক বক্স বিমান দুর্ঘটনার সময় বিমানের তথ্য সংগ্রহ করে, যা দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে সহায়তা করে।
২. বিমান দুর্ঘটনার পর তদন্ত কতদিন লাগে?
দুর্ঘটনার সঠিক কারণ অনুসন্ধান করতে তদন্তে সাধারণত কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।
৩. বাংলাদেশে বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন?
বাংলাদেশে বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে, তবে কিছু ক্ষেত্রে আরও উন্নতি প্রয়োজন।
৪. বিমান ভ্রমণ কতটা নিরাপদ?
বিমান ভ্রমণ পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ পরিবহন মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে দুর্ঘটনার হার অত্যন্ত কম।
৫. বিমান দুর্ঘটনা ঘটলে কী করা উচিত?
বিমান দুর্ঘটনা ঘটলে সর্বপ্রথম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং সঠিক জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।