
বর্তমান যুগে ইউটিউব (YouTube) শুধু বিনোদনের একটি মাধ্যম নয়, এটি অনেকের জন্য আয়ের উৎসও। বাংলাদেশে বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে ইউটিউব চ্যানেল খুলে মনিটাইজেশন করার প্রবণতা বাড়ছে দিন দিন। কিন্তু ইউটিউব মনিটাইজেশন পলিসি ২০২৫ নিয়ে অনেকেই এখন চিন্তিত। এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব ইউটিউব মনিটাইজেশন পলিসি ২০২৫, মনিটাইজেশন কিভাবে করবো, নতুন শর্তাবলী, জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল কীভাবে তৈরি করবেন, এবং সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর
ইউটিউব মনিটাইজেশন পলিসি ২০২৫ এ কি কি পরিবর্তন এসেছে
ইউটিউব মনিটাইজেশন পলিসি হল ইউটিউব কর্তৃপক্ষের তৈরি নিয়মাবলী, যা অনুসরণ করে ইউটিউবাররা তাদের ভিডিও থেকে আয় করতে পারে। ২০২৫ সালে এই নীতিমালায় কিছু নতুন শর্ত ও নিয়ম যুক্ত হয়েছে। মূলত, ইউটিউব মনিটাইজেশন করার জন্য আপনাকে ইউটিউব পার্টনার প্রোগ্রামে (YouTube Partner Program) যোগদান করতে হবে এবং ইউটিউবের নির্ধারিত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে ইউটিউব তাদের “repetitious content” নীতির নাম পরিবর্তন করে “inauthentic content” করেছে। এই আপডেট অনুযায়ী, যেসব ভিডিও বারবার একই ধরণের, কৃত্রিমভাবে তৈরি, অথবা শুধুমাত্র ভিউ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বানানো হয়, সেগুলো আর মনিটাইজযোগ্য নয়। এই ধরনের কনটেন্ট ইউটিউবের চোখে এখন ‘অরিজিনাল’ নয় এবং তা দিয়ে আয় করা যাবে না। তবে এটি ইউটিউবের পুরনো “reused content” নীতিকে প্রভাবিত করে না। যেমন— কমেন্টারি, ক্লিপস, রিঅ্যাকশন ভিডিও এখনও মনিটাইজযোগ্য, যদি সেগুলো যথাযথভাবে রূপান্তরিত ও অরিজিনাল রূপে উপস্থাপন করা হয়।
মনিটাইজেশন কিভাবে কাজ করে?

মনিটাইজেশন মানে আপনার ভিডিওতে বিজ্ঞাপন দেখানো হয় এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের থেকে আপনি আয় করেন। ভিডিওতে কতটা বিজ্ঞাপন দেখানো হবে, তার উপর নির্ভর করে আপনি কত টাকা পাবেন। ভিউ (views) ও ক্লিক (clicks) এর মাধ্যমে আয় নির্ভর করে। সাধারণত, ইউটিউব প্রতি ১০০০ ভিউতে কত টাকা দেয় তা বিভিন্ন দেশে এবং বিজ্ঞাপন ধরণের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে আনুমানিক ১০০০ ভিউতে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত আয় হতে পারে। তাই ইউটিউব মনিটাইজেশন পেতে হলে আপনাকে শুধু ভিউ বাড়াতেই হবে না, মানসম্মত কনটেন্ট দিতে হবে যা দর্শকরা বেশি দেখবে।
মনিটাইজেশন করার জন্য কি কি লাগে ২০২৫?
২০২৫ সালের নতুন মনিটাইজেশন পলিসি অনুসারে ইউটিউব মনিটাইজেশন করতে হলে আপনার চ্যানেলকে অবশ্যই এই শর্তগুলো পূরণ করতে হবে
- সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা: কমপক্ষে ১০০০ সাবস্ক্রাইবার থাকতে হবে।
- ওয়াচ টাইম: সর্বশেষ ১২ মাসে ৪০০০ ঘন্টার ভিউ বা ওয়াচ টাইম থাকতে হবে।
- কমিউনিটি গাইডলাইনস মেনে চলা: কোনো ভিডিওতে কপিরাইট লঙ্ঘন, অশ্লীলতা, হিংস্রতা বা বিভাজনমূলক ভাষা ব্যবহার করলে মনিটাইজেশন বাতিল হতে পারে।
- অরিজিনাল কনটেন্ট: অন্যের কনটেন্ট কপি করে নয়, নিজস্ব ভিডিও বানাতে হবে।
- অ্যাকাউন্টের বৈধতা: ইউটিউবের নিয়মাবলী ও টার্মস এন্ড কন্ডিশন মেনে চলতে হবে।
- Ai জেনারেটেড কোন ভিডিও বা অডিও থাকা যাবে না। (অরিজিনাল কন্টেন্ট এর উপর নজর দিতে হবে)
- ইউটিউব মনিটাইজেশন চেক করবো কিভাবে?
আপনার ইউটিউব চ্যানেল মনিটাইজেশন যোগ্য কিনা চেক করতে পারেন ইউটিউব স্টুডিওর Monetization সেকশনে গিয়ে। সেখানে দেখানো হয় আপনার চ্যানেল কতটুকু যোগ্য এবং কি কি শর্ত পূরণ করতে হবে। মনিটাইজেশন এপ্লাই করার জন্য—
১. ইউটিউব স্টুডিওতে লগইন করুন।
২. বাম মেনু থেকে Monetization অপশন সিলেক্ট করুন।
৩. পলিসি ও শর্তাবলী পড়ে সম্মত হন।
৪. আপনার Adsense অ্যাকাউন্ট সংযোগ করুন।
৫. ইউটিউব আপনার চ্যানেল রিভিউ করবে। সফল হলে মনিটাইজেশন চালু হয়ে যাবে।
ইউটিউব মনিটাইজেশন এ কি কি চেক করে?
মনিটাইজেশন রিভিউ এখন আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। ২০২৫ সালের মার্চে ইউটিউব জানায় যে তারা ad suitability review প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এনেছে। এখন থেকে ভিডিও পাবলিশ করার পর (এমনকি প্রাইভেট ভিডিও হলেও) সেগুলোর মনিটাইজেশন চেকের সময় মানুষের মাধ্যমে অতিরিক্ত রিভিউ করা হতে পারে। এই রিভিউ সম্পন্ন হতে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ইউটিউবের মতে, এটি মনিটাইজেশন সিদ্ধান্তের যথার্থতা বাড়াবে এবং চ্যানেলের আয় সম্ভাবনা উন্নত করবে।
চ্যানেল মনিটাইজেশন রিভিউয়ের সময় ইউটিউব কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে খেয়াল করে: চ্যানেলের প্রধান থিম ও উদ্দেশ্য, সর্বাধিক ভিউ হওয়া ভিডিওসমূহ, নতুন ভিডিও, ওয়াচ টাইম, সর্বোচ্চ অবদান রাখা ভিডিও, ভিডিওর MetaData (Headline, Tags, Description, Thumbnail),চ্যানেলের “About” সেকশন এই বিষয়গুলো ছাড়াও ইউটিউব চাইলে আপনার চ্যানেলের অন্য যেকোনো অংশ বিশ্লেষণ করতে পারে মনিটাইজেশন অনুমোদনের আগে। আরো জানুন: ভোটার আইডি কার্ড ডাউনলোড করুন মাত্র ১ মিনিটে
রাশিয়া সংক্রান্ত নীতিমালা
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউটিউব রাশিয়াতে সব ধরনের গুগল ও ইউটিউব বিজ্ঞাপন বন্ধ রেখেছে এবং সেখানে মনিটাইজেশন ফিচার (Channel Memberships, Super Chat, Super Stickers, Merch) সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় করেছে। যদিও এটি সরাসরি বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়, তবে বৈশ্বিক প্রভাব থাকলে বুঝে নেওয়া জরুরি।
ইউটিউব চ্যানেল খুলতে কত টাকা লাগে?
আসলে ইউটিউব চ্যানেল খুলতে কোনো টাকা লাগেনা। শুধু একটি গুগল অ্যাকাউন্ট থাকলেই হয়। তবে ভালো ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার ইত্যাদি নিতে চাইলে খরচ হতে পারে। শুরুতে মোবাইল ফোন দিয়েও ভালো মানের ভিডিও তৈরি করা যায়।
জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল কোন ধরনের হয়?
বাংলাদেশে জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেলের মধ্যে রয়েছে— শিক্ষামূলক ভিডিও বিনোদনমূলক কনটেন্ট (হাস্যকর, কমেডি) গেমিং চ্যানেল রান্না ও লাইফস্টাইল ভিডিও ভ্লগিং ও ট্রাভেল ভিডিও যে ধরনের কনটেন্টে দর্শকরা বেশি আকৃষ্ট হয় এবং নিয়মিত ভিডিও আপলোড হয়, সেই চ্যানেলগুলো বেশি জনপ্রিয় হয়।
ইউটিউবে কত ভিউতে কত টাকা পাওয়া যায়?

ইউটিউবে আয় অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে— ভিউ, দর্শকের অবস্থান, ভিডিওর দৈর্ঘ্য, বিজ্ঞাপনের ধরন ইত্যাদি। সাধারণত ইউটিউবে প্রতি ১০০০ ভিউ থেকে ২০-৫০ টাকা আয় হতে পারে। ১০০,০০০ ভিউতে প্রায় ২,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। মাসে ২,০০০ টাকা আয়ের জন্য আনুমানিক ৪০,০০০ থেকে ১,০০০,০০০ ভিউ প্রয়োজন হতে পারে, আপনার ভিডিওর জনপ্রিয়তা ও বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর নির্ভর করে।
ইউটিউব মনিটাইজেশন সমস্যা সমাধান কিভাবে করবেন?
অনেক সময় ইউটিউব মনিটাইজেশন চেক করেও সমস্যা দেখা দেয়— মনিটাইজেশন বাতিল হয়ে যায় বা বিজ্ঞাপন প্রদর্শন বন্ধ হয়। ভিডিওর কপিরাইট সমস্যার কারণে মনিটাইজেশন বন্ধ হতে পারে। কমিউনিটি গাইডলাইন লঙ্ঘনের কারণে ইউটিউব সতর্ক করে বা চ্যানেল সাসপেন্ড করতে পারে।
সমাধান:
- ইউটিউবের অফিসিয়াল হেল্প সেন্টার থেকে নিয়মিত আপডেট পড়ুন।
- কপিরাইট লঙ্ঘন এড়িয়ে অরিজিনাল কনটেন্ট তৈরি করুন।
- কমিউনিটি গাইডলাইন অনুসরণ করুন।
- ইউটিউব ফোরাম বা স্থানীয় ইউটিউবারদের সাথে যোগাযোগ রাখুন।
উপসংহার
ইউটিউব মনিটাইজেশন পলিসি ২০২৫ বাংলাদেশের যুব সমাজের জন্য এক নতুন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। সঠিক নিয়ম মেনে মনিটাইজেশন করলে ইউটিউব থেকে নিয়মিত এবং বৈধ আয় করা সম্ভব। তাই নতুন মনিটাইজেশন নীতিমালা সম্পর্কে সবসময় আপডেট থাকা, নিয়মিত ভাল মানের ভিডিও বানানো এবং দর্শকদের সাথে সংযুক্ত থাকা জরুরি। তোমার ইউটিউব চ্যানেল যদি সফল হোক এবং মনিটাইজেশন চালু করতে পারো, তাহলে এটি হতে পারে তোমার নিজস্ব আয়ের উৎস। তাই মনিটাইজেশন কিভাবে করবো, কিভাবে চেক করব এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভয় পেও না, ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা করো সফলতা আসবেই।
FAQ:
ইউটিউব মনিটাইজেশন করতে কি কি লাগে?
ইউটিউব মনিটাইজেশন পেতে হলে ১০০০ সাবস্ক্রাইবার, ৪০০০ ঘণ্টা ওয়াচ টাইম, কপিরাইট ফ্রি এবং অরিজিনাল কনটেন্ট থাকতে হবে।
ইউটিউব মনিটাইজেশন কিভাবে বুঝবো?
ইউটিউব স্টুডিওতে গিয়ে “Monetization” অপশন থেকে চেক করা যায় চ্যানেল মনিটাইজেশন স্ট্যাটাস।
ইউটিউব মনিটাইজেশন নীতিমালা কী?
এটি ইউটিউবের সেট করা নিয়ম যা অনুসরণ করলে একজন ক্রিয়েটর ভিডিও থেকে বৈধভাবে আয় করতে পারেন। ২০২৫ সালে এর মধ্যে নতুন “inauthentic content” নীতিও যুক্ত হয়েছে।
ইউটিউব মনিটাইজেশন করতে কত টাকা লাগে?
ইউটিউব চ্যানেল খুলতে কোনো টাকা লাগে না, তবে প্রফেশনাল কনটেন্ট তৈরি করতে মোবাইল, ক্যামেরা, মাইক্রোফোন ও ইন্টারনেট খরচ লাগতে পারে।
ইউটিউবে ১০০০ ভিউতে কত টাকা আয় হয়?
বাংলাদেশে প্রতি ১০০০ ভিউতে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত আয় হতে পারে, নির্ভর করে ভিডিওর ধরণ ও দর্শকের লোকেশন অনুযায়ী।
ইউটিউবে মাসে ২০০০ টাকা আয় করতে কত ভিউ লাগে?
আনুমানিক ৪০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ ভিউ প্রয়োজন হতে পারে, যদি ভিডিওর CPM কম থাকে।
ইউটিউব চ্যানেল মনিটাইজেশন বাতিল হলে কী করব?
ইউটিউবের কমিউনিটি গাইডলাইনস ভালোভাবে পড়ে দেখুন, প্রয়োজনে ভিডিও এডিট করে আবার আবেদন করুন অথবা হেল্প সেন্টারে যোগাযোগ করুন।