বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন:লাশের মিছিল কিংবা আহতদের আর্তনাদ যেনো থামার নয়
সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় গত ৫ জুলাই থেকে। শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে হয়ে উঠে রক্তক্ষয়ী।
প্রথমে ছাত্রদের আন্দোলনকে দমাতে পাঠানো হয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগ যুবলীগের কর্মীদের।
তাতেও ছাত্রদের দমানো না গেলে পরে একে একে পুলিশ,বিজিবি ও আর্মি নামানো হয়।
ফলে সাধারণ ছাত্রসমাজ এবং সরকারি দল পরস্পর বিপরীত মুখী অবস্থানে চলে যায়। সরকারদলীয় এমপি–মন্ত্রী এবং নেতাকর্মীদের একের পর এক বিস্ফোরক মন্তব্যে ছাত্ররা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। শেষদিকে তা পরিণত হয় সরকার পতনের আন্দোলনে।
সরকারি চাকরিতে কোটার আদিকথা:
১৯৮৫ সাল থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয় এবং বাকি ৫৫ শতাংশ নিয়োগ হয় কোটার ভিত্তিতে। পরবর্তীতে ১% প্রতিবন্ধী কোটা যোগ করা হলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশে। যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০%,নারী কোটা ১০%,জেলা কোটা ১০%,উপজাতি কোটা ৫% এবং প্রতিবন্ধী কোটা ১%। অর্থাৎ ১০০ জনের মধ্যে ৫৬ জনই নিয়োগ পাবেন কোটায় এবং বাকি ৪৪% নিয়োগ পাবেন মেধায়।
তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে এই বৈষম্য আরো প্রকট।এই বৈষম্য দূরীকরণের জন্যই বারবার চাকরীপ্রার্থী ছাত্ররা আন্দোলন করে এসেছিলেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুর কথা:
কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন শুরু ২০১৮ সাল থেকে।এর আগে ২০১৩ সালেও কোটা নিয়ে আন্দোলন হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সব ধরণের কোটা বাদ দিয়ে সে বছরই অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করা হয়। তবে এর বিরূদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান অহিদুল ইসলাম সহ ৭ জন রিট দায়ের করেন।
২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রাথমিক শুনানি শেষে আদালত রুল জারি করেন। এবং চুড়ান্ত শুনানির পর ২০২৪ সালের ৫ জুন এই রুলকে যথাযথ বলে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এর ফলে সরকারি চাকরিতে আগের কোটাপদ্ধতিই বহাল থাকে।
৮ জুলাই থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সকল গ্রেডের সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক কোটা বাদ দিয়ে কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়ে সংসদে আইন পাসের জন্য আন্দোলন শুরু করেন।
দাবি আদায়ের জন্য তারা “বাংলা ব্লকেড” শিরোনামে অবরোধ শুরু করেন। আন্দোলনের কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলেও তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
১৪ ই জুলাই রবিবার,সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন“
মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি–পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি–পুতিরা চাকরি পাবে?’
এরপরেই ছাত্ররা ফুঁসে উঠে। “তুমি কে আমি কে?রাজাকার রাজাকার;কে বলেছে কে বলেছে?স্বৈরাচার স্বৈরাচার” স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে সারা দেশ।
১৮ জুলাই বৃ্হস্পতিবার সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন,
“আমরা অবশ্যই (কোটা) সংস্কারের ব্যাপারে নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করেছি। আমরা কোটা সংস্কারের পক্ষে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার আজই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসতে রাজি আছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের (শিক্ষার্থী) এ প্রস্তাবকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।’
তবে এতোগুলো লাশের উপর দিয়ে আলোচনায় বসতে চায়নি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজ। তারা বলেছিলেন,”ভাইয়ের রক্তের সাথে আমরা বেঈমানি করতে পারি না। তাই আমরা কোনো আলোচনায় বসবো না।“
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতের সং্খ্যা:
২৮ আগস্ট শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এখনো পর্যন্ত নিহতের সং্খ্যা কমপক্ষে ৭৬০ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু বিভিন্ন স্কুল কলেজ,মাদ্রাসা,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই নন,রয়েছে নারী,শিশু,পথচারী,বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার সাধারণ মানুষ।
এদের মধ্যে বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয়েছে গুলির কারনে। অনেকে ঘটনাস্থলেই মারা যান,আবার কেউ কেউ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
২৭ জুলাই সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহত হয়েছেন শাহরিয়ার সোহান নামের একজন শিক্ষার্থী। তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯ জুলাই ঢাকার রামপুরায় গুলিবিদ্ধ হন। ঢাকা সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৭ আগস্ট তার মৃত্যু হয়। তার দেশের বাড়ি মাগুরায়।
২০২৪ এর কোটা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রংপুরের আবু সাঈদ। তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৬ জুলাই দুপুর ১২ টা থেকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই বিক্ষোভ করছিলো। সেদিন বেলা আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনকারীদের ছত্রভংগ করার জন্য পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে ও লাঠিচার্জ করে। সে সময় অন্য সবাই স্থান ত্যাগ করলেও আবু সাঈদ হাতে একটি লাঠি নিয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিশ একের পর এক রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে তার দিকে। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই আবু সাঈদের মৃত্যু হয়।
আবু সাঈদের মৃত্যুর পর থেকেই আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে উঠে। শিক্ষার্থীদের স্লোগান হয়ে উঠে,”আমার ভাই মরলো কেনো?জবাব চাই জবাব দাও।“
“বুকের ভেতর অনেক ঝড়,বুক পেতেছি গুলি কর।“
পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে এখনো পর্যন্ত নিহতের সং্খ্যা ৭৬০ জন। এদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সং্খ্যা সং্খ্যা ৯১।
ঢাকার ১৩ টি ,ঢাকার বাইরের ১৪ টি হাসপাতাল ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায় এদের সবার মৃত্যুই আন্দোলকালীন সংঘর্ষে হয়েছে।
এদের মধ্যে ৬৯ জনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি। এবং বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি আরো ১৫৭ জনের।
নিহতদের মধ্যে ৬৭ জন শিশু রয়েছে,যাদের ৫৭ জনেরই মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। আন্দোলনে অনেক নারীর মৃত্যুও হয়েছে।
আন্দোলনকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত সময়কে ধরা যায়,যা ছিলো মূলত কোটার যৌক্তিক সংস্কারের পক্ষে সাধারন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।
৩ আগস্টের পর থেকে এটি আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে থেমে না থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। এবং এ পর্যায়ে সমাজের প্রতিটি শ্রেণী পেশার মানুষ শিক্ষার্থীদের আহবানে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। এটিকে বলা যায় ছাত্র–জনতার আন্দোলন।
আহত নিহতের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আন্দোলনের শুরুর দিকে,১৬ জুলাই ৪ জন সাধারণ শিক্ষার্থীসহ ৬ জন আইনশৃং্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে নিহত হয়।
এরপর ১৮ থেকে ২১ জুলাই রাজধানী সহ সারা দেশে ভয়াবহ সহিংসতায় মৃত্যু হয় আরো ৩০৫ জনের।
৩ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরো ৩০ জন মারা যায়।
এরপর দ্বিতীয় ভাগের আন্দোলনে শুধুমাত্র ৪ আগস্টই সারা দেশে ১১৬ জনের মৃত্যু হয়। সেদিন পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরাও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের উপর হামলা করে।
৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। ৫ ও ৬ আগস্ট সারাদেশে অন্তত আরো ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়। ৪,৫ ও ৬ আগস্ট এই তিনদিনে মোট মৃত্যুর সং্খ্যা দাঁড়ায় কমপক্ষে ৩৮১ জন।
নিহতদের মধ্যে ৮৮ জন আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী। এরা মূলত ৫ ও ৬ তারিখে সরকার পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে মারা যায়।
অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাদের ১১৭ নেতাকর্মী ও সমর্থকের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তথ্যমতে আন্দোলনে নিহতদের অন্তত ৮৭ জন ছিলেন তাদের নেতাকর্মী।
নিহত ৭৬০ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৪২৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে গুলিতে।
তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে প্রকৃত মৃত্যুর সং্খ্যা হাজারেরও অধিক। কারন ইন্টারনেট শাটডাউনের ফলে আন্দোলনের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায় নি। আন্দোলন চলাকালীন ১৭ জুলাই ফোন ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই থেকে ব্রডব্যান্ড সেবা বন্ধ করে দেয় সরকার। ৫ দিন পর সীমিত পরিসরে চালু হয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। আর এর ফলে আহত নিহতের প্রকৃত সংখ্যা মিডিয়ার সামনে আসে নি।
অনেককে গণকবর দেওয়ার খবরও উঠে এসেছে।
শুধু যাত্রাবাড়িতেই মারা গেছে ৮৬ জন।
পুলিশের সদর দপ্তর বলছে আন্দোলনে সারাদেশে ৪৪ পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে।
আন্দোলনে আহতের সং্খ্যা:
বিবিসি বাংলার তথ্যমতে ৩০ জুলাই পর্যন্ত অন্তত ৫ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন আন্দোলনকে ঘিরে। ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ৩০–৩৫ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। তবে প্রকৃত সং্খ্যা এখনো অজানা।
তথ্যসূত্র:
-prothomalo.com
-kalerkantho.com
–বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন(অফিসিয়াল গ্রুপ)