বই পড়া বিলাসিতা, Reels দেখা আবশ্যকতা
০৩ বছর বয়সের একটি বাচ্চা Reels দেখছে, মোবাইলটি কেড়ে নিয়ে দেখেন তার প্রতিক্রিয়া। আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে সোশাল মিডিয়া । যুগের সাথে সাথে রুচির পরিবর্তন হচ্ছে সমগ্র মানবজাতির। ২০ বছর আগেও মানুষের কাছে বই পড়া ছিল একটি সাধারন যুবক যুবতীর কাছে বিনোদন এর অন্যতম একটি মাধ্যম। কালের বির্বতনে বই থেকে মোবাইল, মোবাইল থেকে Reels এখন সবার কাছে বিনোদন এর একচেটিয়া মাধ্যম। আপনি কি জানেন, একজন সাধারণ মানুষ প্রতিদিন কত সময় সামাজিক মিডিয়ায় Reels দেখার জন্য ব্যয় করে? কেন ১০ বছর আগে একজন সাধারণ ব্যক্তি দিনে একটি উপন্যাস পরে শেষ করতে পারতেন আর এখনকার যুবকেরা ৩০ সেকেন্ড এর Reels দেখে রাত্রিযাপন করে ?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশদ প্রচার
সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর উত্থান আমাদের যোগাযোগের পদ্ধতিকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে দীর্ঘ সময়ের ভিডিওর চেয়ে Reels এর জনপ্রিয়তা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে। এই সংক্ষিপ্ত ভিডিওগুলো আমাদের বিনোদন দেয়, আমাদের হাসায় এবং কখনও কখনও আমাদের শিক্ষা দেয়। কিন্তু এই বিনোদনের পিছনে আমাদের ঠিক কি পরিমান সময় ব্যয় হয়, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি?
Reels এর জনপ্রিয়তা
Reels এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের মনোযোগের সময়কাল কমে যাওয়া একটি প্রধান কারণ। ২০২৪ সালের ইন্সটাগ্রাম পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি মাসে ২ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ Reels এর সাথে যোগাযোগ করে। Reels সাধারণ ভিডিও পোস্টের তুলনায় ২২% বেশি ইন্টারঅ্যাকশন পায়। ফেসবুকে প্রতিদিন ১৪০ বিলিয়নেরও বেশি Reels দেখা হয়, যা মে ২০২২ থেকে ৫০% বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি স্পষ্ট করে যে, ফেসবুক Reelsকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং ব্যবহারকারীরাও Reels দেখতে চাচ্ছেন। এছাড়াও, ফেসবুক Reelsে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পৌঁছানোর সম্ভাব্য দর্শক সংখ্যা প্রায় ৬১৬.৮ মিলিয়ন, যা ফেসবুকের মোট বিজ্ঞাপন পৌঁছানোর ৩১.১%। এই তথ্যগুলো আমাদের দেখায় যে, আমরা Reels এর প্রতি কতটা আসক্ত।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দেখা ইনস্টাগ্রাম Reels এর মালিক ভারতের ফ্রিস্টাইল ফুটবলার মুহাম্মদ রিজওয়ান, যার ভিউ সংখ্যা ৪৯১ মিলিয়নেরও বেশি।
২০ বছর আগে এবং এখনকার মানুষের মধ্যে বিনোদনের মাধ্যমের পার্থক্য
২০ বছর আগে, যখন ইন্টারনেট এবং সামাজিক মিডিয়া এত জনপ্রিয় ছিল না, তখন মানুষের দৈনন্দিন জীবন এবং বিনোদনের পদ্ধতিও ছিল অনেকটাই ভিন্ন। তখনকার মানুষ কাজের জন্য বেশি সময় ব্যয় করতেন এবং বিনোদনের জন্য বই পড়া, টেলিভিশন দেখা বা বন্ধুদের সাথে দেখা করতেন। সেই সময়ে, একটি সাধারণ অফিস কর্মী গড়ে ৮-১০ ঘণ্টা কাজ করতেন এবং অবসর সময়ে বিনোদনের জন্য বাইরে ঘুরতে যেতেন, বই পরতেন, নাটক দেখতেন।
অন্যদিকে, আজকের দিনে, প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে আমাদের দৈনন্দিন কাজ ও বিনোদন এর মাধ্যম পরিবর্তিত হয়েছে। যদিও আমরা প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক কিছু সহজে করতে পারি, তবে সামাজিক মিডিয়ার কারণে আমাদের মনোযোগের সময়কাল কমে গেছে।
২০২৪ সালের গুগল স্ট্যাটিসটিক্স অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাধারণ একজন ব্যক্তি ১.৫ থেকে ২ ঘণ্টা সামাজিক মিডিয়ায় সময় ব্যয় করে, যদিও বাস্তব চিত্র তার চেয়ে অনেক ভিন্ন। তারপরো এই সময়কে সঠিক ধরে এর মধ্যে ৩০-৫০% অর্থাৎ ৬০-১০০ মিনিট Reels দেখার জন্য ব্যয় হয়। এটি একটি উল্লেখযোগ্য সময়, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য কার্যকলাপ থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। অনেক সময় আমরা একটি Reels দেখে শুরু করি এবং একের পর এক ভিডিও দেখতে দেখতে সময়ের ধারণা হারিয়ে ফেলি। বিশেষ করে উঠতি বয়সের বাচ্চাদের দেখা অবস্থায় মোবাইল কেড়ে নিলে দেখা যায় তাদের প্রতিক্রিয়া।
প্রভাব এবং পরিণতি
Reels দেখার এই অভ্যাসের কিছু ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ইতিবাচক দিক হলো, Reels অতি অল্প সময়ে আমাদের বিনোদন দেয় এবং আমাদের সৃজনশীলতাকে উন্নত করে। তবে, এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। Reels দেখার পেছনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার ফলে আমাদের উৎপাদনশীলতা কমে যেতে পারে এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
Reels দেখা সম্পূর্ণভাবে বাদ না দিলেও আমরা নিজেদের জন্য কিছু নিয়ম তৈরী করতে পারি। এখানে কিছু কার্যকর টিপস দেয়া হলো:
1. সময় সীমা নির্ধারণ করুন: প্রতিদিন সামাজিক মিডিয়ায় কত সময় ব্যয় করবেন তা নির্ধারণ করুন। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা ঠিক করলে আপনি আপনার সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবেন।
2. স্ক্রীন টাইম ট্র্যাকিং অ্যাপ ব্যবহার করুন: আপনার ফোনে স্ক্রীন টাইম ট্র্যাক করতে সাহায্যকারী কিছু অ্যাপ ব্যবহার করুন। এই অ্যাপগুলো আপনাকে আপনার প্রতিদিন কোন অ্যাপ্লিকেশন কত সময় ধরে ব্যবহার করেছেন তার পরিসংখ্যান দেখাবে।
3. অফলাইন কার্যকলাপে সময় দিন: মাঝে মাঝে মোবাইল এবং সকল ইলেকট্রনিক গ্যাজেট থেকে দূরে থাকুন। বই পড়া, ব্যায়াম করা বা শখের কাজে সময় দিন। অফলাইন কার্যকলাপ আপনার মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করবে এবং সামাজিক মিডিয়ার প্রতি আপনার আসক্তি কমাতে পারে।
4. নিয়মিত বিরতি নিন: সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করার সময় নিয়মিত বিরতি নিন। এটি আপনার মনোযোগ পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করবে এবং আপনাকে আরও প্রোডাক্টিভ হতে উৎসাহিত করবে।
5. *সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার পরিকল্পনা করুন*: আপনার সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারের একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করুন। কোন সময়ে কি ধরনের কনটেন্ট দেখবেন তা নির্ধারণ করুন, যাতে আপনি অপ্রয়োজনীয় স্ক্রোলিং থেকে বিরত থাকতে পারেন।
উপসংহার
সামাজিক মিডিয়ায় Reels এর প্রতি আমাদের আসক্তি একটি বাস্তবতা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। তবে, আমাদের উচিত আমাদের সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। আসুন, আমরা আমাদের সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারের অভ্যাস নিয়ে চিন্তা করি এবং প্রয়োজনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করি।
আমাদের এই আর্টিকেলের সাথে আপনার জীবনে কতটুকু মিল পরেছে জানান কমেন্টে। সাথে জানাবেন আপনি কতক্ষন Reels দেখেন?