১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামে উৎসর্গ করা হয় দিনটিকে। অনেকে একে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ নামেও চেনে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়। ইতিহাসে এর বয়স ১৭৫৫ বছর হলেও ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ নামে পরিচিতি বেশিদিনের না।
ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস (১ম)
রোমিউলাস নামে একজন ব্যক্তি নেকড়ের দুধ পান করেন। এতে তিনি অনেক শক্তি ও জ্ঞান অর্জন করেন। পরে তিনি প্রাচীন রোমের প্রতিষ্ঠাতা হন। এই কাহিনির ওপর ভিত্তি করে রোমানরা ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি উৎসব পালন করত। এই উৎসবে অদ্ভুত কিছু কাজ হতো। দুইজন যুবক কুকুর ও ভেড়ার রক্ত গায়ে মাখত। তারপর তারা রক্ত ধুয়ে দীর্ঘ পদযাত্রায় অংশ নিত। তাদের হাতে চাবুক থাকত। চাবুক দিয়ে তারা পথচারীদের আঘাত করত। তখনকার রোমান নারীরা বিশ্বাস করত, চাবুকের আঘাত খেলে বন্ধ্যাত্ব দূর হবে। তাই তারা স্বেচ্ছায় চাবুক খেত। রোমানরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও উৎসব চালিয়ে যেতে থাকে।
ভ্যালেন্টাইন ডে এর ইতিহাস (২য়)
ভ্যালেন্টাইন ডে’র অপর গল্পটি শুরু হয় রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস এবং খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে দিয়ে। তৃতীয় শতকে সম্রাট ক্লাডিয়াস সমগ্র রোমানবাসীকে ১২জন দেব-দেবীর আরাধনা করার নির্দেশ দেন। সেসময় খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি খ্রিস্টানদের সঙ্গে মেলামেশার জন্যও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক পাদ্রীকে সম্রাট ক্লাডিয়াস তাকে কারাগারে বন্দি করে রাখেন। তিনি খ্রিষ্টান ধর্মকে মনেপ্রানে ধারন করতেন। সেখানকার কারারক্ষী তাকে, তার অন্ধ মেয়েকে পড়াশোনা করার জন্য অনুরোধ করেন। অন্ধ জুলিয়া চোখে দেখতে পেতেন না, কিন্তু ছিলেন খুব বুদ্ধিমতী। ভ্যালেন্টাইন তাকে রোমের ইতিহাস পড়ে শোনাতেন, পাটিগণিত শেখাতেন ও ঈশ্বর সম্পর্কে বলতেন।
একদিন জুলিয়া ভ্যালেন্টাইনকে জিজ্ঞেস করেন—
– ভ্যালেন্টাইন, সত্যিই কি ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শোনেন?
– হ্যাঁ, তিনি সবই শোনেন।
– আমি রোজ প্রার্থনা করি, যদি আমি দেখতে পেতাম।
– ঈশ্বর আমাদের জন্য যা ভালো, তা-ই করেন।
প্রার্থনার পর একদিন জুলিয়া ঠিকই দৃষ্টি ফিরে পেলেন।
কিন্তু সময় ঘনিয়ে এলো ভ্যালেন্টাইনের। ক্লাডিয়াস তার মৃত্যুদণ্ডের দিন ধার্য করলেন— ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২৭০ অব্দ। মৃত্যুর আগের দিন ভ্যালেন্টাইন জুলিয়াকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির শেষে লেখা ছিলো— “ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন”। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু কার্যকর হয়। তাকে বর্তমান রোমের প্রক্সিদেস গির্জার স্থলে সমাহিত করা হয়।
ভ্যালেন্টিইন ডে পালন শুরু হয় কবে থেকে?
৪৯৬ সালে পোপ প্রথম গেলাসিয়াস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। এর পর থেকে দিনটি ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ওঠে। ১৮ শতকে ইংল্যান্ড ও ইউরোপে এ দিবসে প্রেমের বার্তা, উপহার আদান-প্রদান শুরু হয়।
ভালোবাসা দিবস ২০২৫
ভালোবাসা দিবসের নামে দেশে অনৈতিকতা ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক জায়গায় এই দিনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। কেউ প্রতারণার শিকার হয়, কেউবা হতাশায় আত্মহত্যা করে। পরকীয়ায় লিপ্ত হওয়া অনেক বিবাহ সম্পর্ক টিকছে না। সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়, এই দিনকে কেন্দ্র করে নানা অপরাধ ঘটে। এর পরিণতি ভয়াবহ, যা ইসলামের শিক্ষা বিরোধী। ইসলাম এ ধরনের কাজ সমর্থন করে না।
ভালোবাসা দিবস ইসলাম কি বলে?
ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি খ্রিস্টানদের উৎসব বা পৌত্তলিকদের একটি প্রথা। অনেকের কাছে এটি বেহায়াপনার দিন হিসেবেও পরিচিত। রাসূল (সা.) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করবে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই একজন বলে গণ্য হবে’ (আবূ দাউদ হা/৪০৩১)।
মুসলিম সমাজে ক্রমশ বিজাতিদের অনুকরণ বাড়ছে। বিশেষ করে ধর্মীয় আচার এবং বিশ্বাসে দুর্বলতা বাড়ছে। ইসলামে ভালোবাসা নির্ধারিত তারিখে পালন করা যায় না। ১৪ ফেব্রুয়ারি বা ভালোবাসা দিবস পালনকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে গর্হিত ও নিন্দিত বলা হচ্ছে। আরো জানুনঃ থার্টি ফার্স্ট নাইট সম্পর্কে ইসলাম কি বলে?
মুসলমানদের জন্য এই দিনটি পালন করা নিষিদ্ধ। ইসলামিক পান্ডিত ব্যক্তিদের মতে, ইসলামে তরুণ-তরুণীদের অবৈধ ভালোবাসা অনুমোদন করা হয়নি।
ভ্যালেন্টাইন ডে তে করণীয় কি?
বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে পালনকারী তরুণরা পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অপ্রাকৃত ভালোবাসা জীবনে জটিলতা তৈরি করতে পারে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে, স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব গ্রহণ করছে। নিজেদের স্বকীয়তা ভুলে, ধর্মীয় নিয়মকানুন উপেক্ষা করে তারা প্রগতিশীল হওয়ার চেষ্টা করছে। এতে নৈতিক অবক্ষয় ও সম্পর্কের পরিণতি দুর্বল হতে পারে। সমাজকে এসব অপসংস্কৃতির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
ইসলামে ভালোবাসা আল্লাহ, রাসুল, বাবা-মা, ভাই-বোন, শিক্ষক ও আলিম-উলামার সাথে হতে হবে। তা ছাড়া গরীব-অসহায় মানুষের প্রতি, এলাকাবাসী ও দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা উচিত। এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব এবং জান্নাতের পথ খুলে যায়। অন্যদিকে, নিষিদ্ধ ভালোবাসা বা অপসংস্কৃতি গ্রহণ করলে এর পরিণতি জাহান্নামে পৌঁছাতে পারে।
বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের প্রবর্তক কে?
বাংলাদেশে প্রথম ১৯৯৩ সালে শফিক রহমান, যায়যায়দিন পত্রিকার সাংবাদিক ও সম্পাদক, ভালোবাসা দিবস পালন শুরু করেন। তিনি লন্ডনে পড়ালেখা করার সময় পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে এই দিবসটি বাংলাদেশে প্রচলন করেন। তাই তাকে বাংলাদেশের ভালোবাসা দিবসের জনক বলা হয়।
এই দিনে, প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু-বান্ধবী, স্বামী-স্ত্রী, মা-সন্তান, ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন সম্পর্কের মানুষ একে অপরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে ফুল, চকলেট, কার্ড ও উপহার দিয়ে। বাংলাদেশের পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে এই দিনে খুব ভিড় থাকে। তবে, এটি কোনো সরকারি ছুটি নয়। সামাজিক গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভালোবাসা দিবস উদযাপনে বড় ভূমিকা রাখে। ফুলের দোকান, ফ্যাশন হাউজ, উপহার দোকান এবং ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টগুলো বিশেষ অফার দেয়।
টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে “ভালোবাসা দিবসের গান” ও “ভালোবাসা দিবসের নাটক” দেখানো হয়। এর মধ্যে জনপ্রিয় একটি নাটক হচ্ছে “ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প”, যা তরুণদের ভুল পথে পরিচালিত করে।