তোমরা সত্যকে মিথ্যের সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না। @@ surah baqara ayat 42 Al Quran 2:42 @@

সময়ের কাজ সময়ে করা এত কঠিন কেন?

সময়ের কাজ সময়ে করা এত কঠিন কেন?
সময়ের কাজ সময়ে করা এত কঠিন কেন?- ফাইল ছবি

” সময়ের কাজ সময়ে করাকে সময়ানুবর্তিতা বলে “—এই কথাটি পরীক্ষার খাতায় লেখতে লেখতে কলমের কালি ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে এর চর্চা কতটা করি আমরা? আমরা অনেকেই সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করি, কিন্তু সেটা ধরে রাখা খুব কঠিন। কিছু সময় আমরা ফেসবুক ইনস্টাগ্রামের রিলস দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সময়ানুবর্তিতার পথে হাঁটতে চাই, কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই ডোপামিন হারিয়ে যায় কোথায়, তা হয়ত গুগলেও খুজে পাবে না। আজকের লেখায় আমরা সময়ানুবর্তিতার গুরুত্ব যেমন আলোচনা করব, তেমনি এটি কেন কঠিন এবং কীভাবে এই কঠিন কাজকে বাস্তবে প্রয়োগ করবেন তা নিয়ে কথা বলব।

কেন আমরা সময়ানুবর্তী হতে পারি না?

আমরা সবাই জানি যে সময়ের কাজ সময়ে করা উচিত। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অজস্র ব্যস্ততা, মানসিক চাপ, আলস্য, বা শুধু ‘পরে করব’ ভাবনার কারণে কাজ জমে থাকে। প্রাইমারি স্কুলে দেরিতে ভর্তি হওয়া, পড়াশোনার কাজ ফেলে রাখা, কিংবা বড়দের ক্ষেত্রে অফিসের কাজ নির্ধারিত সময়ে না করা—এগুলো আমাদের জীবনের খুবই সাধারণ ঘটনা। শেক্সপিয়র বলেছেন,

“আমি সময় অপচয় করেছি, এখন সময় আমাকে অপচয় করছে।”

উদাহরণস্বরূপ, অনেক ছাত্র সেমিস্টার শুরুর আগে সম্পূর্ণ সিলেবাস পড়ার পরিকল্পনা করে কিন্তু বাস্তবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কিছুই করে না। ঠিক তেমনই একজন পেশাজীবী হয়তো কাজ শুরু করার আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট করে ফেলে।

তাহলে প্রশ্ন হলো: সময়ের কাজ সময়ে করা হয় না কেন?

১. অলসতা: সময়মতো কাজ করার প্রধান বাধা হলো অলসতা। কাজ শুরু করার আগেই ‘পরে করব’ এই ভাবনায় ডুবে যাওয়া থেকে বের হতে হবে।

২. কাজের অগ্রাধিকার না দেওয়া: অনেক সময় আমরা জানি না কোন কাজ আগে করব। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে রেখে অপ্রয়োজনীয় কাজ নিয়ে সময় নষ্ট করি। এ বিষয়ে ইট দ্যাট ফ্রগ বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হলোঃ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ / কঠিন কাজটি সবার আগে করা।

৩. মোটিভেশন কমে যাওয়া: যখন আমরা কোন কাজ সম্পন্ন করার জন্য একটি ভালো প্ল্যান করি, তখন কাজ শুরুর দিকে সবাই খুব মোটিভেশনাল থাকি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা বা দিন পরে সেই উদ্দীপনা হারিয়ে যায়। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে সম্পূর্ণ ফোকাসড থাকা বর্তমান সময়ে খুবই কষ্টকর।

৪. ফোকাস নষ্টকারী উপাদান: ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, বা অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা আমাদের সময় নষ্ট করে, বিশেষ করে রিলস। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রিলস দেখে অপ্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করার পরিসংখ্যান খুবই ভয়ংকর চিত্র প্রদর্শন করে। ৩০ সেকেন্ডের রিলস কেড়ে নিচ্ছে ৫ ঘন্টার ঘুম

বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা

ইসলামের প্রাথমিক যুগের অনেক মহান ব্যক্তিত্ব সময়ানুবর্তিতার মাধ্যমে তাদের জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করেছিলেন। ইসলামের মৌলিক ভিত্তি ৫ টির মধ্যে ৪ টিই নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট কিছু কাজ সম্পন্ন করার মাধ্যমে পালন করা হয়। পবিত্র কোরআনের সূরা আসর এ মহান আল্লাহ সময়ের শপথ ও করেছেন।

সময় যদি আমরা সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করতাম, তবে প্রতিদিনের মিনিটগুলো গণনা করতাম যেন এক সেকেন্ডও অপচয় না হয়।

মহানবী ﷺ বলেছেন,

“তোমার স্বাস্থ্যের পাশাপাশি তোমার অবসর সময় হলো সবচেয়ে বড় নেয়ামতের একটি।”

বাইবেলে বলা হয়েছে, “সময়ের প্রতি যত্নবান হও, কারণ দিনগুলো খারাপ।” (ইফিষীয় ৫:১৬)।

হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “কাজকে ধ্যান করে করো, কারণ সময় অমূল্য এবং এটি ফিরে আসে না।”

আসলে কি করলে এই সমস্যার মুক্তি পাবো?

সময়ানুবর্তী হওয়া কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। অভ্যাসের দাস না হয়ে, অভ্যাসকে নিজের দাস বানান। এখানে কিছু বাস্তবধর্মী পরামর্শ দেওয়া হলো:

1. অলসতা কাটানোর ছোট পদক্ষেপ নিন:

১০০% সফল পরিকল্পনা করার পরিবর্তে ছোট কাজ দিয়ে শুরু করুন। সময় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিকল্পনা পরিবর্তন করুন। প্রতিদিন মাত্র ১০ মিনিট সময় দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করুন। ধীরে ধীরে সময় বাড়ান।

2. অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করুন:

যদি সব কাজকে সমান গুরুত্ব দেন, তাহলে কোনো কাজই সময়মতো হবে না। যে কাজগুলো এখনই করতে হবে সেগুলো লিস্টের উপরে রাখুন। প্রথমে সেই কাজগুলো বেছে নিন যেগুলো জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ।

3. প্রলোভন এড়িয়ে চলুন:

ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়ার মতো প্রলোভন থেকে দূরে থাকতে হলে কাজের সময় ফোন সাইলেন্টে রাখুন। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার জন্য দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন। আপনার সোশ্যাল মিডিয়া আপনার জীবনে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা মনে রাখুন সবসময়।

4. ‘না’ বলতে শিখুন:

আপনার নিজের সীমাবদ্ধতা বোঝা জরুরি। কেউ বাড়তি কাজ দিতে চাইলে, যা আপনার সময় নষ্ট করবে, তা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করুন। আপনার হাতের কাজের ব্যস্ততা তাকে দেখিয়ে ভালো ব্যবহারের সাথে না বলুন।

5. পরিকল্পনা তৈরি করুন:

প্রতিদিন একটি তালিকা তৈরি করুন। কোন কাজ কখন করবেন, তা পরিকল্পনা করুন। পরিকল্পনা বাস্তবে রূপান্তর করা কঠিন হলেও এটি আপনার অনেক সময় বাঁচায়।

6. নিজেকে সময় দিন:

অবসাদ এবং চাপ কমাতে কাজের মাঝেমধ্যে বিরতি নিন। এটি আপনাকে পুনরায় কাজের জন্য প্রস্তুত করবে।

সময়ানুবর্তিতার ইতিবাচক প্রভাব

যদিও সময়ের কাজ সময়ে করা কঠিন, এটি জীবনে বিশাল পরিবর্তন আনে। কাজ সঠিক সময়ে হলে মানসিক চাপ কমে এবং দিন শেষে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। যদিও শুরুতে এটি কঠিন মনে হয়, ধীরে ধীরে এটি অভ্যাসে পরিণত হয়।

FAQ: পাঠকের সাধারণ প্রশ্ন

১. সময়ানুবর্তিতা কেন এত কঠিন?

সময়ানুবর্তিতা কঠিন কারণ আমরা অলসতা, মনোযোগ নষ্টকারী উপাদান, এবং প্রলোভন থেকে দূরে থাকতে পারি না। এটি ধৈর্য এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।

২. কীভাবে সময়ানুবর্তিতা চর্চা শুরু করব?

ছোট ছোট কাজ দিয়ে শুরু করুন, অলসতা পরিহার করুন, এবং কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করুন।

৩. সময়ানুবর্তিতা জীবনে কী পরিবর্তন আনতে পারে?

সময়ানুবর্তিতা মানসিক চাপ কমায়, কাজের গতি বাড়ায় এবং জীবনে শৃঙ্খলা আনে।

৪. সফল ব্যক্তিরা সময়ানুবর্তিতা কীভাবে চর্চা করেন?

তারা কাজের তালিকা তৈরি করেন, মনোযোগ নষ্টকারী উপাদান এড়িয়ে চলেন, এবং প্রতিটি কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেন।

উপসংহার

সময়ানুবর্তিতা কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নয়। এটি ধীরে ধীরে শেখা একটি অভ্যাস, যা আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। সফলতার পথে এটি আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *