বগুড়ার চানাচুর বিক্রেতা থেকে দেশজুড়ে আলোচিত ‘হিরো আলম’—সম্প্রতি আবার ভাইরাল সংবাদ শিরোনামে তিনি। হিরা আলম রিয়া মনির ডিভোর্সের খবর ভাইরাল হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তোলপাড় । কিন্তু এই বিতর্কের আড়ালে আসলে কে? কিভাবে হয়ে উঠলেন তিনি আজকের সেলিব্রিটি?
হিরো আলম রিয়া মনির ডিভোর্স – সর্বশেষ খবর
বুধবার রাত ২টার ফেসবুক লাইভে হিরো আলমের জ্বলন্ত প্রশ্ন:
“আমার স্ত্রী আর তার ‘প্রেমিক’ ম্যাক্স অভি কক্সবাজারের হোটেলে কেন?”
সঙ্গে শেয়ার করা হয় দুজনের রুমের ছবি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভিডিওটি ৫ লাখ ভিউ অতিক্রম করে, যেখানে দেখা যায় রিয়া মনি ও ম্যাক্স অভিকে হোটেল করিডরে।
হিরো আলমের স্ত্রীর অভিযোগ
রিয়া মনি বলেন, “তালাক দিয়েছি। হিরো আলম এখন মানসিকভাবে অস্থির।” তাঁর দাবি, গত বছর বাবার মৃত্যুর সময় হিরো আলম তাকে হাসপাতালে যেতে দেননি। পাল্টা হিরো আলমের অভিযোগ, “রিয়া আমার বাবাকে শেষ দেখা দেখেনি। এখন অভির সঙ্গে পালাচ্ছে।”
স্থানীয় টেলিভিশনকে তিনি (হিরো) আরও বলেন, “আমি সংবাদ সম্মেলনে সব প্রমাণ দেব। রিয়া আমাকে ব্যবহার করে সেলিব্রিটি হতে চেয়েছে।” উল্লেখ্য, ২০২২ সালে আত্মহত্যার চেষ্টার পর রিয়া মনিই তাকে সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলেছিলেন।
হিরো আলম ভাইরাল হয় কিভাবে ?
বগুড়ার ইরুলিয়া ইউনিয়নের মাটির বাড়িতে জন্ম নেওয়া আশরাফুল আলমের ডাকনাম ছিল ‘আলম’। ১০ বছর বয়সে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে পরিবার ভেঙে যায়। ২০১৯ সালের এক সাক্ষাৎকারে “মাকে নিয়ে রাতে রাস্তায় নামতে হয়েছিল,” বলে স্মৃতিচারণ করেন তিনি । শুরু হয় অভাবের সংসার। মাত্র ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল কুড়িয়ে পাওয়া এক জোড়া সোনার দুল। সেই টাকায় চানাচুরের ব্যবসা শুরু। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
“ভাইয়েরা স্কুলে যেত, আমি পাড়ায় পাড়ায় চানাচুর ফেরি করতাম।”
সপ্তম শ্রেণিতে ফেল করার পরই শেষ হয় শিক্ষাজীবন। কিন্তু এই ব্যর্থতাই পরবর্তীতে তাঁর ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে—“আমি সপ্তম শ্রেণিতে ফেল করেছি, কিন্তু আজ ২২ লাখ মানুষ আমাকে ফলো করে।”
আরো জানুন; পৃথিবীর টপ ১% সফল ব্যক্তিদের অভ্যাস: কেন তারা এত সফল?
অ্যাডলফ খানকে দেশের সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষের অ্যাওয়ার্ড কে দিয়েছে?
চানাচুর বিক্রেতা থেকে বিনোদন জগতে ভাইরাল হিরো আলম
এক সিডির দোকানে কাজ করতেন। দোকনের মালিক বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ায় ১৫ বছর বয়সে সেই সিডি দোকান কিনে ফেলেন কিস্তিতে। দিনে চানাচুর বিক্রি, রাতে সিডি দোকান—এই রুটিন থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছিলেন তিনি। এর মধ্যে গ্রামে আসে ডিস ক্যাবল। ২০০৫ সালে ‘সকাল সন্ধ্যা কেবল নেটওয়ার্ক’ নামে স্থানীয় ক্যাবল টিভি চালু করেন। হিন্দি গানের সাথে নিজে ভিডিও গান প্রস্তুত করে নিজের ক্যাবল টিভিতে প্রচার শুরু করেন। স্থানীয়দের উৎসাহে ২০০৮ সালে মাত্র ১ বছরে ৫০০ এর উপরে ভিডিও তৈরী করেন।
এলাকার মানুষের কটাক্ষ তাকে দমাতে পারে নি। ২০০৮ সালের একটি সাক্ষাৎকারে বলেন,
“লোকেরা বলত, ‘তোর চেহারায় হিরো হওয়া হবে না।’ আমি নামের আগেই ‘হিরো’ জুড়ে দিলাম।”
সেই বছরই বানান প্রথম ভিডিও ‘প্রেম করবো আমি’।
২০১৬ সালের ভাইরাল হিরো আলম
একজন ইউটিউবার accidentally শেয়ার করে দেন তাঁর ‘ও মাই লাভ’ ভিডিওটি। ৪৮ ঘণ্টায় ১০ লাখ ভিউ—বাংলাদেশের ডিজিটাল ইতিহাসে তখন রেকর্ড।
ঢাকার সাংস্কৃতিক মহল তাকে ‘অপসংস্কৃতি’ আখ্যা দিলেও ব্র্যান্ডগুলো টের পায় তাঁর মার্কেটিং ক্ষমতা। ২০১৭ সালে একটি মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপন ২ মিলিয়ন ভিউ পায়। সোর্স
কলকাতার ‘বিজু দ্য হিরো’ চলচ্চিত্রের অফার আসে। আমেরিকা থেকে ইভেন্ট ইনভাইটেশন পান। তাঁর মডেলেই পরবর্তীতে তৈরি হয় ‘নাটোকর’ ট্রেন্ড।
হিরো আলমের গল্প শুধু একজন মানুষের নয়, একটি ডিজিটাল যুগের প্রতিচ্ছবি। যেখানে ভাইরালিটির শক্তি প্রথাগত যোগ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে। আজ ডিভোর্সের খবরে আলোচিত এই ব্যক্তিত্বই আগামীকাল হয়তো আবার নতুন কোনো বিতর্কে কিংবা সাফল্যে হাজির হবেন—কারণ তাঁর জীবনের মন্ত্রই হলো: “আমি পারি, আপনিও পারবেন।”
হিরো আলম এর সিনেমা
২০১৯ সালে নিজের প্রযোজনায় বানালেন ‘মার ছক্কা’। বাজেট মাত্র ১৫ লাখ টাকা, কিন্তু মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই ইউটিউবে ২ মিলিয়ন ভিউ। সমালোচকদের ভাষায় “টেকনিক্যালি দুর্বল কিন্তু গ্রামীণ দর্শকের রসবোধে আঘাত হানেছে”। ২০২২ সালের ‘সাহসী হিরো আলম’ তে দেখা গেল হিরো-ভিলেন ডুয়েল—যেখানে দুই চরিত্রেই তিনি নিজে!
বছর | চলচ্চিত্রের নাম | ভূমিকা | ধরণ | বিশেষ তথ্য |
---|---|---|---|---|
2019 | মার ছক্কা | প্রধান নায়ক | অ্যাকশন | প্রথম স্ব-প্রযোজিত চলচ্চিত্র |
2020 | সাহসী হিরো আলম | দ্বৈত ভূমিকা | ড্রামা | হিরো ও ভিলেন দুটো চরিত্রে |
2022 | হিরো: দ্য সুপারস্টার | নিজ চরিত্রে | ডকুড্রামা | জীবনীভিত্তিক |
2023 | হিরো আলমের রিটার্ন | অ্যাকশন হিরো | অ্যাকশন | 5টি হলে মুক্তি পায় |
2021 | বিজু দ্য হিরো | বিশেষ উপস্থিতি | অ্যাকশন | ভারতীয় প্রযোজনা (অপ্রকাশিত) |
*সকল চলচ্চিত্র বাংলা ভাষায় এবং হিরো আলম নিজে প্রযোজনা করেছেন |
হিরো আলম এর গান
২০২১ সালে “আমার প্রাণের মধ্যে আছে” গানটি গেয়ে তোলপাড় ফেলে দেন। রবীন্দ্রপুরীথের এক বক্তব্যে বলা হয়, “এটি সংস্কৃতির মর্যাদাহানি”। পাল্টা তাঁর যুক্তি: “আমি গান ভালোবাসি, গুরুদেবের গান তো সবার জন্য”। ঘটনাটি পুলিশি তদন্ত পর্যন্ত গড়ায়, যা তাঁর জনসমর্থন বাড়িয়ে দেয়।
বছর | গানের নাম | ধরণ | উল্লেখযোগ্য তথ্য |
---|---|---|---|
2016 | ও মাই লাভ | পপ | প্রথম ভাইরাল গান, ১০ মিলিয়ন+ ভিউ |
2017 | প্রেম করবো আমি | রোমান্টিক | ইউটিউবে ট্রেন্ডিং #১ বাংলাদেশ |
2018 | বাংলার হিরো | প্যাট্রিওটিক | স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশিত |
2019 | মার দিয়া ছক্কা | ফিল্মি | চলচ্চিত্র “মার ছক্কা” এর থিম সং |
2020 | আমি পারি | ইনস্পিরেশনাল | হিরো আলমের জীবন দর্শনের গান |
2021 | আমার প্রাণের মধ্যে আছে | রবীন্দ্রসংগীত | বিতর্কিত রবীন্দ্রসংগীত কভার |
বছর | গানের নাম | ধরণ | উল্লেখযোগ্য তথ্য |
---|---|---|---|
২০২২ | হিরো রিটার্নস | হিপহপ | নিজের জীবন নিয়ে র্যাপ |
বাংলাদেশী ভাই | প্যাট্রিওটিক | জাতীয় দিবসে প্রকাশিত | |
২০২৩ | টিকটক হিরো | পপ | টিকটকে ৫ মিলিয়ন+ ভিউ |
বিয়ে করবো | রোমান্টিক | রিয়া মনিকে নিয়ে গান | |
চানাচুর ওয়ালা | আত্মজীবনীমূলক | শৈশবের স্মৃতিনির্ভর | |
২০২৪ | এমপি হিরো | পলিটিক্যাল | নির্বাচনী প্রচারণার গান |
ডিভোর্স সোং | ইমোশনাল | রিয়া মনির সাথে বিচ্ছেদ নিয়ে | |
২০২৫ | আমি ফিরে আসবো | ইনস্পিরেশনাল | নতুন প্রজেক্টের প্রোমো গান |
মোট গান: ৮টি (২০২২-২০২৫) |
সাংস্কৃতিক মহলে আলোচনা-সমালোচনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ বলেন, “এটি পপুলিজম বনাম এলিটিজমের লড়াই।” অন্যদিকে, গ্রামীণ দর্শকদের মতে, “সিনেমায় তো আমাদের মতো মানুষই দেখতে চাই।”
অন্যান্য বড় বিতর্ক ও আলোচনায় আসা ঘটনা
বছর | বিষয় | বিস্তারিত |
---|---|---|
২০২২ | বাবার মৃত্যু | হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়ার ভাইরাল ভিডিও, স্ত্রী রিয়া মনিকে অভিযোগ করেন “শেষ দেখা দেখতে আসেনি” |
মানসিক সংকট | বাবার মৃত্যু পরবর্তীতে আত্মহত্যার চেষ্টা | |
বিবাহবিচ্ছেদ | রিয়া মনির সাথে সম্পর্কের অবনতি ও সর্বশেষ তালাকের ঘটনা | |
২০২৩ | আরাভ খান ইস্যু | ডুবাইয়ে পুলিশের তালিকাভুক্ত আসামির সাথে ছবি তোলায় বিতর্ক |
২০২৩ | সাংস্কৃতিক বিতর্ক | মামুনুর রশীদের “রুচির দুর্ভিক্ষ” মন্তব্যের জবাব দেন: “ক্ষুধার্তের সংস্কৃতি বোঝেনা ভদ্রলোকরা” |
২০১১-২০২৩ | রাজনৈতিক ব্যর্থতা | ২০১১ ও ২০১৬ সালে উপজেলা নির্বাচনে পরাজয় |
জাতীয় নির্বাচন | ২০১৮ সালে মাত্র ৮,৯০৩ ভোট পেয়ে পরাজিত | |
উপনির্বাচন | ২০২৩ সালে বগুড়া-৪ আসনে ৮৩৪ ভোটে পরাজয় | |
মোট সংকট: ৭টি প্রধান ঘটনা (২০১১-২০২৩) |
ফেসবুক ও ইউটিউব সেলিব্রিটি
২.২ মিলিয়ন ফেসবুক ফলোয়ার—যা বাংলাদেশের ৯৫% সেলিব্রিটিদের ছাড়িয়ে গেছে। ইউটিউব চ্যানেলের ৭৮% দর্শক গ্রামীণ যুবক, যাদের ৬৮% বয়স ১৮-২৫ বছরের মধ্যে (সোশ্যাল ব্লেড ডেটা, ২০২৪)। রংপুরের এক চা দোকানের আলোচনা: “ওই যে বলে—’আমি পারি’… এটাই তো আমাদের কথাই বলে।” সমাজবিজ্ঞানী ড. নাসরিন খানের গবেষণায় উঠে এসেছে—
“তাঁর সাফল্য গ্রামীণ যুবকদের ‘অসম্ভবকে সম্ভব’ করার বিশ্বাস জোগায়।”
ঢাকার এক সাহিত্য সম্মেলনে কবি হাসান আজিজুল হক বলেন, “এটি বাজার অর্থনীতির ফসল।” অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জের এক গার্মেন্টস কর্মীর কথায়: “টিভির নায়করা তো আমাদের ভাষায় কথা বলে না, হিরো আলম বলে।”
হিরো আলমের দৃষ্টিভঙ্গি বদলান বই
২০২০ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীমূলক বইয়ের মূল বক্তব্য: “সমস্যা আপনার চিন্তায়, বাস্তবতায় নয়।” বইটি গ্রামীণফোনের রেকর্ডে ৩ মাস টপ সেলার ছিল। বগুড়ার এক স্কুলে দেওয়া বক্তৃতায় বলেন:
“সপ্তম শ্রেণিতে ফেল করেছি, কিন্তু আজ আমেরিকান ইউনিভার্সিটি আমাকে লেকচার দিতে ডাকে।”
“আমি ১১২ বার রিজেক্ট হয়েছি, ১১৩তম বারেই তো সাফল্য আসবে!”